অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ
বাংলায় বন্যা—খুলনা দুর্ভিক্ষ—উত্তরবঙ্গে প্রবল বন্যা—অল্পদিন
পূর্বেকার বন্যা—ভারতে অনুসৃত শাসনপ্রণালীর কিঞ্চিৎ পরিচয়—
শ্বেতজাতির দায়িত্বের বোঝা
১৯২১ সালে আমি যখন চতুর্থবার ইংলণ্ড ভ্রমণ করিয়া আসিলাম সেই সময়, খুলনা জেলায় সুন্দরবন অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। কলিকাতায় থাকিয়া আমি অবস্থার গুরুত্ব বুঝিতে পারি নাই। মে মাসে গ্রীষ্মের ছুটীর সময় আমি যখন গ্রামে গেলাম, তখন আমার চোখের সম্মুখেই দুর্ভিক্ষের ভীষণতা দেখিতে পাইলাম। পর পর দুই বৎসর অজন্মার ফলেই এই অবস্থার সৃষ্টি হইয়াছিল। জনসাধারণের ‘মা বাপ’ ম্যাজিষ্ট্রেট কালেক্টর এ অবস্থা দেখিয়াও অবিচলিত ছিলেন। কিন্তু সংবাদপত্রে ইহা লইয়া খুব আন্দোলন হইতেছিল। গবর্ণমেণ্টের চক্ষুকর্ণস্বরূপ ম্যাজিষ্ট্রেট এ সব বিষয় তুচ্ছ মনে করিতেছিলেন, চারিদিক হইতে অন্নকষ্টের যে হাহাকার উঠিতেছিল, তাহা গ্রাহ্য করা তিনি প্রয়োজন মনে করেন নাই, তিনি তাঁহার সদর আফিসে বসিয়া নিশ্চিন্তমনে যে বিবৃতি প্রচার করিয়াছিলেন, তাহা লোকে কখনও ভুলিতে পারিবে না। উহা হইতে কয়েক ছত্র উদ্ধৃত করিতেছি:—“প্রায় প্রত্যেক গ্রামেই অপর্যাপ্ত ফল জন্মে, খাল হইতে ছোট ছোট ছেলেরাও মাছ ধরিতে পারে এবং চাহিলেই একরূপ বিনামূল্যে দুধ পাওয়া যায়।” ভারতের দুর্ভিক্ষের সঙ্গে যাঁহাদের কিছু পরিচয় আছে, তাঁহারাই জানেন যে, দুধ অসম্ভবরূপে সস্তা হওয়া—দুর্ভিক্ষের ভীষণতার লক্ষণ। পিতামাতা তাহাদের শিশু সন্তানকে বঞ্চিত করিয়া দুধ বিক্রয় করে, যদি তাহার পরিবর্তে কিছু চাল পাওয়া যায়। কিন্তু দুধ কিনিবে কে? কেন না ভারতে এখন দুর্ভিক্ষের অর্থ—টাকার দুর্ভিক্ষ। পাঠককে এ কথাও স্মরণ করাইয়া দেওয়া নিষ্প্রয়োজন যে, সুন্দরবন অঞ্চলে ফলের গাছ হয় না এবং ফলের গাছ সেদিকে নাই। এখানে বলা যাইতে পারে যে, ভারতে যখনই কোন স্থানে বন্যা ও দুর্ভিক্ষ হয়, গবর্ণমেণ্ট তাঁহাদের সিমলা বা দার্জিলিঙের শৈলবিহার হইতে, প্রথম প্রথম দুর্গতদের কাতর আবেদনে কর্ণপাত করেন না। ক্রমে যখন সংবাদপত্রে ও সভাসমিতিতে আন্দোলন হইতে থাকে এবং তাহা উপেক্ষা করা কঠিন হইয়া উঠে, আমলাতন্ত্রের প্রভুরা তখন কিঞ্চিৎ অস্বস্তি অনুভব করেন। কিন্তু তখনও ‘সরকারী বিবরণ’ না পাইলে তাঁহারা কিছু করিতে চাহেন না। সেক্রেটারিয়েট এ বিষয়ে বিভাগীয় কমিশনারের উপর নির্ভর করেন, কেন না, তিনিই সংবাদ আদানপ্রদানের ডাকঘর বিশেষ। কমিশনার জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট, জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আবার পুলিশের দারোগার নিকট হইতে রিপোর্ট তলব করেন। দারোগা গ্রাম্য পঞ্চায়েতের উপর এবং পঞ্চায়েত গ্রাম্য চৌকীদারের উপর সংবাদ সংগ্রহের ভার দেন। এইসব চতুর অধস্তন কর্মচারীর দল জানে যে কিরূপ রিপোর্ট গবর্ণমেণ্টের মনোমত হইবে এবং সেই অনুসারেই রিপোর্ট প্রস্তুত হয়। গেজেটে যে সরকারী ইস্তাহার বাহির হয়, তাহা এইরূপ ‘প্রত্যক্ষ সংবাদের’ উপর নির্ভর করিয়া লিখিত। কোন স্বাধীন দেশ হইলে খুলনার ম্যাজিষ্ট্রেট অথবা বন্যার জন্য রেলওয়ে এজেণ্টই যে কেবল কঠিন শাস্তি পাইত, তাহা নহে, মন্ত্রিসভাও বিতাড়িত হইত। কিন্তু ভারতে বন্যা দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে এইসব ব্যাপার নিত্যই ঘটিতেছে।