সাধারণ তন্ত্র ঐশ্বর্যে ও জনবলে বড় বড় সাম্রাজ্যকেও তুচ্ছ করিয়াছে। ইহার কারণ, তাহার প্রধান শক্তি ছিল নৌ-বল এবং বাণিজ্যে। আণ্টোয়ার্প, ওসটেণ্ড, লীজ, ব্রাসেল্স প্রভৃতি ঐশ্বর্যশালী সহর ছিল এবং ঐ সকল স্থানের অধিবাসীরা একদিকে যেমন ধনী অন্য দিকে তেমনই বীর ও দেশহিতৈষী ছিলেন। আবার হল্যাণ্ডই সর্বপ্রথম লুথারের সংস্কারবাদ গ্রহণ করিয়াছিল।
প্রথম চার্লসের রাজত্ব কালে লণ্ডনের ধনী বণিকেরাই পার্লামেণ্টারী সৈন্যের প্রধান সমর্থক ছিল। তাহারাই যুদ্ধের উপকরণ যোগাইত এবং তাহাদের মধ্যে অধিকাংশই পিউরিটান মতাবলম্বী ছিল। পক্ষান্তরে রাজতন্ত্রীদের প্রধান সহায় ছিল, অভিজাত শ্রেণী এবং গ্রাম্য জমিদারগণ। ক্রমওয়েল জনবল ও ধনবলের সাহায্য সর্বদাই লাভ করিয়াছিলেন এবং সেইজন্যই তিনি লণ্ডন সহরের উপর কমনওয়েলথের পতাকা উড্ডীন করিতে পারিয়াছিলেন। লণ্ডন সহর এবং ব্রিস্টল তাঁহাকে এই জনবল ও ধনবল যোগাইত।[১] সুতরাং দেখা যাইতেছে, কোন দেশে, শাসনতন্ত্র সম্বন্ধে উন্নত মতবাদ এবং রাজনৈতিক চেতনা, সমুদ্রযাত্রা এবং ব্যবসা বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধির সঙ্গে ঘনিষ্ঠরূপে জড়িত! যে সব দেশ কেবল মাত্র কৃষিবৃত্তির উপর নির্ভর করিয়াছে, সেখানেই স্বেচ্ছা-শাসনতন্ত্র এবং বিদেশী শাসনের প্রাধান্য দেখা গিয়াছে। তাহার অধিবাসীরা সাধারণতঃ প্রাচীন প্রথা ও কুসংস্কার আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাকে এবং তাহাদের দৃষ্টি সঙ্কীর্ণ ও অনুদার হইয়া পড়ে। বাক্ল তাঁহার—“সভ্যতার ইতিহাস” নামক গ্রন্থে এই কথা বিশেষ ভাবে বলিয়াছেন:—
“আমরা যদি কৃষক ও শিল্পব্যবসায়ীদের তুলনা করি, তবে সেই একই নীতির ক্রিয়া দেখিতে পাইব। কৃষকদের পক্ষে আবহাওয়ার অবস্থা একটি প্রধান সমস্যা। যদি আবহাওয়া প্রতিকূল হইয়া দাঁড়ায় তবে তাহাদের সমস্ত পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। বিজ্ঞান এখনও বৃষ্টির প্রাকৃতিক নিয়ম আবিষ্কার করিতে পারে নাই। মানুষ পূর্ব হইতে এ সম্বন্ধে কোন ভবিষ্যদ্বাণী করিতে পারে না। সুতরাং লোকে মনে করিতে বাধ্য হয় যে, অতিপ্রাকৃত শক্তি বলেই ইহা ঘটে। আমাদের গির্জা সমূহে সেই কারণেই বর্ষার জন্য বা পরিষ্কার আবহাওয়ার জন্য প্রার্থনা করা হয়। ভবিষ্যৎ বংশীয়েরা আমাদের এই কার্য নিশ্চয়ই ছেলেমানুষি মনে করিবে,—আমাদের পূর্ব পুরুষেরা যেরূপ ভীতি মিশ্রিত সম্ভ্রমের সহিত ধমকেতুর আবির্ভাব বা গ্রহণ দেখিত, তাহা আমরা যেমন ছেলেমানুষি বলিয়া মনে করি।... গ্রামবাসীরা যে সহরবাসীদের চেয়ে অধিকতর কুসংস্কারগ্রস্ত হয়, ইহা তাহার একটি প্রধান কারণ। সহরে যাহারা ব্যবসা বাণিজ্য কাজ কর্ম করে, তাহাদের সাফল্য নিজেদের শক্তি ও যোগ্যতার উপরেই নির্ভর করে, যে সমস্ত অতিপ্রাকৃত ঘটনা কৃষকদের মনের উপর প্রভাব বিস্তার করে, সহরবাসীদের সঙ্গে তাহার কোন সম্বন্ধ নাই।”
বর্তমান চীনেও ইহার দৃষ্টান্ত দেখিতে পাওয়া যায়। উত্তর চীন কৃষিপ্রধান, এখানে চিরাচরিত প্রথা ও সাম্রাজ্যবাদের প্রাধান্য, এবং এই অঞ্চল জাতীয় আন্দোলনের প্রধান বাধা স্বরূপ হইয়া রহিয়াছে। পক্ষান্তরে দক্ষিণ চীনই প্রথম সান-ইয়াৎ সেনের আদর্শ ও মতবাদ গ্রহণ করে এবং এখানেই জাতীয়তা বোধ বিকাশ প্রাপ্ত হইয়াছে। ইহার কারণ, ক্যাণ্টন-
- ↑ “প্রায় অর্থ শতাব্দী ধরিয়া লণ্ডন সহর রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং ধর্মসংস্কারের প্রধান সমর্থক ছিল।” মেকলে—ইংলণ্ডের ইতিহাস।
“সহরের ব্যবসায়ীদের মধ্যেই পিউরিটানদের প্রাধান্য খুব বেশী ছিল।”—ঐ
“লণ্ডনের ধনী বণিকদের অধিকাংশই ছিল পিউরিটান।” কার্লাইল—“ক্রমওয়েল”।
“লণ্ডন সহরই এই সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমর্থক ও অর্থসাহায্যকারী ছিল।”—ঐ