পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
২৭

আমি দেখিলাম ল্যাটিন ও সংস্কৃত এই দুই প্রাচীন ভাষায় আশ্চর্য সাদৃশ্য। দৃষ্টান্ত স্বরূপ ল্যাটিন ভাষায় Recuperata pace, artes efflorescunt (শান্তি প্রতিষ্ঠিত হইলে শিল্পকলার বিকাশ হয়) এই বাক্যটির উল্লেখ করা যাইতে পারে। সংস্কৃতে অনুরূপ পদকে ভাবে ৭মী বলে। ইহাতে আমার মন বিস্ময়ে পূর্ণ হইল। সেই অল্পবয়সে এই দুই ভাষার মধ্যে আশ্চর্য সাদৃশ্য সম্পর্কে সমস্ত বিষয় বুঝিবার মত জ্ঞান বা বুদ্ধি আমার হয় নাই, অথবা উহারা যে একটী মূল ভাষা হইতেই উৎপন্ন (Grimm’s Law, Bopp’s Comparative Grammar of the Indo-Aryan Languages প্রভৃতিতে যেরূপ ব্যাখ্যাত হইয়াছে), তাহা ধারণা করিবার শক্তিও আমার ছিল না। কিন্তু আমি তখনই ল্যাটিন শিখিবার সঙ্কল্প করিয়া ফেলিলাম এবং সে সঙ্কল্প অবিলম্বে কার্যে পরিণত করিলাম। শিক্ষকের সাহায্য ব্যতীত এই আমার ল্যাটিন ভাষা শিখিবার সুযোগ। আমি Principia র পাঠগুলি নূতনভাবে মনোযোগ সহকারে দেখিতে লাগিলাম এবং শীঘ্রই Principia র প্রথমভাগ শেষ করিয়া ফেলিলাম। তার পর দ্বিতীয়ভাগ এবং ব্যাকরণ ও পড়িলাম।

 প্রায় সাত মাস আমাশয়রোগে ভুগিবার পর আমি অনেকটা ভাল হইলাম কিন্তু ঐ রোগ একেবারে সারিল না, ১৮৭৫ সাল হইতে জীর্ণব্যাধি রূপে উহা আমার সঙ্গের সাথী হইয়া আছে। উহার ফলে অজীর্ণ, উদরাময় এবং পরে অনিদ্রা রোগেও আমি আক্রান্ত হইলাম। আমি আহারাদি সম্বন্ধে খুব কড়াকড়ি নিয়ম পালন করিতে বাধ্য হইলাম। ক্ষুধাবৃদ্ধি করিবার জন্য সকালে ও সন্ধ্যায় ভ্রমণ করার অভ্যাস করিলাম। যখন গ্রামে থাকিতাম, তখন মাটি কাটিতাম বা বাগানের কাজ করিতাম। সাঁতার দেওয়া এবং নৌকা চালনাও আমার প্রিয় ব্যায়ামের মধ্যে ছিল।

 একটা কঠিন রোগে আক্রান্ত হওয়াকে কেন যে আমি প্রকারান্তরে আশীর্বাদ স্বরূপ মনে করিয়াছিলাম, তাহা এখন বুঝা যাইবে। আমি অনেক সময় লক্ষ্য করিয়াছি, সবলদেহ যুবকেরা তাঁহাদের ‘বাঘের ক্ষুধার’ গর্ব করেন এবং প্রচুর পরিমাণে আহার করেন। কিছু দিন পর্যন্ত তাঁহাদের বেশ ভালই চলে। কিন্তু প্রকৃতি একদিকে যেমন যাহারা তাহার নিয়ম পালন করে তাহাদের উপর সদয়, অন্যদিকে তেমনি নিয়ম লঙ্ঘনকারীদের কঠোর হস্তে শাস্তিদান করিয়া থাকে। এই সমস্ত লোক গর্ববশতঃ স্বাস্থ্যের সাধারণ নিয়ম ভঙ্গ করে, ফলে বহুমূত্র, বাত, স্নায়বিক বেদনা প্রভৃতি রোগে ভুগিয়া থাকে। সম্প্রতি কলিকাতার কয়েকটী জমিদার পরিবারে আমার যাইবার প্রয়োজন হইয়াছিল। যদিও তখন বেলা দশটা, তথাপি তাঁহাদের কেহ কেহ শয্যা হইতে গাত্রোত্থান করেন নাই। অন্য কেহ কেহ তাঁহাদের বিশাল দেহ লইয়া বসিতে অসমর্থ হইয়া মেজের কার্পেটের উপর অজগর সর্পের মত পড়িয়া ছিলেন। আমি তাঁহাদের মুখের উপর বলিলাম যে, তাঁহাদের সমস্ত ঐশ্বর্যের সঙ্গেও আমি আমার সাদাসিধা অভ্যাস ও কর্মময় জীবন বিনিময় করিতে পারি না। কিন্তু কেবল এই শ্রেণীর লোককে দোষ দিয়া লাভ কি? আমাদের কোন কোন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি, যাঁহাদের জন্য সমস্ত ভারত গৌরবান্বিত, স্বাস্থ্যের প্রাথমিক নিয়মগুলি উপেক্ষা করাতে অকালে ইহলোক ত্যাগ করিতে বাধ্য হইরাছেন। অতিরিক্ত মানসিক পরিশ্রম অথচ শরীর চালনার অভাব—ইহারই ফলে কেশবচন্দ্র সেন, কৃষ্ণদাস পাল, বিচারপতি তেলাঙ্গ, বিবেকানন্দ, গোখেল প্রভৃতি বহুমূত্র রোগে আক্রান্ত হইরা অকালে মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছেন। ৪৪ বৎসর হইতে ৪৬ বৎসর বয়সের মধ্যে তাঁহাদের অধিকাংশের মৃত্যু হইয়াছে; অথচ ঐ বয়সে একজন ইংরাজ-মাত্র জীবন-মধ্যাহ্নে উপনীত হইয়াছে বলিয়া মনে করে। ইহার দ্বারা দেশের যে কত বড় ক্ষতি হয়, তাহার ইয়ত্তা করা যায় না। মনে ভাবুন, গোখেল যদি আরও দশ