বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
৪৭

শাসনের তুলনায় হীন প্রতিপন্ন হইবে? একথা ভুলিলে চলিবে না, যখন রাণী মেরী ধর্মসম্বন্ধীয় মতভেদ ও গোঁড়ামির জন্য নিজের প্রজাদিগকে অগ্নিকুণ্ডে বা কারাগারে নিক্ষেপ করিতেছিলেন, ঠিক সেই সময়ে পরাক্লান্ত মোগল বাদশাহ আকবর সর্বধর্মের প্রতি উদারনীতি ঘোষণা করিয়াছিলেন এবং মৌলবী, পণ্ডিত, রাবি, এবং মিশনারীকে দরবারে আহ্বান করিয়া তাঁহাদের সঙ্গে বিভিন্ন ধর্মের সম্বন্ধে দার্শনিক আলোচনায় প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। কেহ হয়ত একথা বলিতে পারেন যে, আকবরের কথা স্বতন্ত্র, তাঁহাকে মোগলদের প্রতিনিধি গণ্য করা যাইতে পারে না। ইহা অত্যন্ত ভ্রান্ত কথা। ধর্ম বিষয়ে উদারতা মোগল বাদশাহদের পক্ষে সাধারণ নিয়ম ছিল, বিরল ঘটনা ছিল না।”

 উত্তর প্রদেশের প্রধান সংবাদ পত্র “স্কটসম্যান” এই প্রবন্ধ সমালোচনা প্রসঙ্গে লিখিয়াছিলেন,—“এই ক্ষুদ্র বহিখানি খুবই চিত্তাকর্ষক। ইহাতে ভারত সম্বন্ধে এমন অনেক তথ্য আছে, যাহা অন্যত্র পাওয়া যায় না। এই গ্রন্থের প্রতি সকলের দৃষ্টি আমরা বিশেষভাবে আকর্ষণ করিতেছি।” কিন্তু এই ঐতিহাসিক আলোচনার উৎসাহ আমাকে সংযত করিতে হইল। আমার শীঘ্রই বি, এস্-সি, পরীক্ষা দিবার কথা, এবং রসায়নশাস্ত্রের দাবী রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্য উপেক্ষা করা যায় না। আমি গভীরভাবে আমার প্রিয় রসায়নশাস্ত্রের আলোচনায় আত্মনিয়োগ করিলাম। বি, এস্-সি, ডিগ্রী পাওয়ার পর আমাকে ‘ডক্টর’ (D. Sc.) উপাধির জন্য প্রস্তুত হইতে হইল; এজন্য কোন মৌলিক গবেষণা মূলক প্রবন্ধ দাখিল করা প্রয়োজন। লেবরেটরীতে গবেষণা এবং ইংরাজী, ফরাসী, ও জার্মাণ ভাষায় লিখিত রসায়নশাস্ত্র অধ্যয়ন—ইহাতেই আমার সময় কাটিতে লাগিল। ১৮৮৫—১৯২০ পর্যন্ত আমার সমগ্র সময় বলিতে গেলে রসায়নশাস্ত্রের চর্চাতেই ব্যয় হইয়াছে।

 এডিনবার্গের শীতল, স্বাস্থ্যকর জলবায়ুতে আমাদের দেশের অপেক্ষা বেশী পরিশ্রম করা যায়, অথচ কোন ক্লান্তি বোধ হয় না। লেবরেটরীতে কাজ শেষ হইবার পর গৃহে ফিরিবার পূর্বে আমি খুব খানিকটা বেড়াইয়া আসিতাম।

 আমি সমাজে বড় বেশী মেলামেশা করিতাম না। কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল। কিন্তু যে কারণেই হউক ঐ সমস্ত পরিবারের বয়স্ক পুরুষদের সঙ্গই তরুণীদের সঙ্গ অপেক্ষা আমার ভাল লাগিত। বয়স্ক পুরুষদের সঙ্গে আমি নানা বিষয়ে আলোচনা করিতে পারিতাম। কিন্তু যখনই তরুণীদের সঙ্গে আমার পরিচয় হইত, আমার কেমন সঙ্কোচ বোধ হইত এবং মামুলী আবহাওয়া, জলবায়ু, ইত্যাদি বিষয় ছাড়া আর কোন বিষয়ে কথা বলিতে পারিতাম না। ঐরূপে দুই চারিটা কথা শীঘ্রই শেষ হইয়া যাইত এবং নূতন কোন বিষয় খুঁজিয়া না পাইয়া আমি অপ্রতিভ হইয়া পড়িতাম। আমার কোন কোন ভারতীর বন্ধু নারীমহলে আলাপ পরিচয়ে বেশ সপটু ছিলেন। ঘটনাক্রমে কোন সমাজের মধ্যে পড়িলে তাহার ‘ধাত’ বুঝিয়া আলাপ জমাইয়া তুলিবার মত দক্ষতা আমার ছিল না। কেহ যেন মনে না করেন যে, আমি নারীবিদ্বেষী ছিলাম অথবা নারী জাতির সৌন্দর্য ও মাধুর্য অনুভব করিবার শক্তি আমার ছিল না। বস্তুতঃ রসায়নশাস্ত্রের খ্যাতনামা প্রবর্তক ক্যাভেন্‌ডিশের চেয়ে এ বিষয়ে যে আমি সৌভাগ্যবান ছিলাম, এজন্য নিজকে ধন্য মনে করি।

 ডাঃ এবং মিসেস কেলী (ক্যাম্পো ভার্ডি, টিপারলেন রোড) প্রতি শনিবারে ভারতীয় ও অন্যান্য বিদেশী ছাত্রদের স্বগৃহে অভ্যর্থনা করিতেন। প্রবীণ দম্পতীর সঙ্গে আমার বেশ সৌহার্দ্য ছিল। একবার আমার পুরাতন ব্যাধি উদরাময়ে আমি ভুগিতেছিলাম। তখন সেই সহৃদয় দম্পতী আমাকে দেখিতে আসিয়াছিলেন এবং আমার জন্য বিশেষভাবে