পাতা:আত্মপরিচয় - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

গাঁথতে ও পরাতে পারে না। যদি সময় পেত সুন্দর করে বিনিয়ে বিনিয়ে গাঁথত। এখন ওকে ব্যস্ত লোকেরা ধমক দিয়ে বলে, রেখে দাও তোমার সুন্দর। সুন্দর পুরানো, সুন্দর সেকেলে। আনো একটা যেমনতেমন করে পাক-দেওয়া শণের দড়ি—সেটাকে বলব রিয়ালিজ্‌ম এখনকার দুদ্দাড়-দৌড়-ওয়ালা লোকের ঐটেই পছন্দ। স্বল্পায়ু ফ্যাশান হঠাৎ নবাবের মতো উদ্ধত— তার প্রধান অহংকার এই যে, সে অধুনাতন, অর্থাৎ তার বড়াই গুণ নিয়ে নয়, কাল নিয়ে।

 বেগের এই মোটর কলটা পশ্চিমদেশের মর্মস্থানে। ওটা এখনো পাকা দলিলে আমাদের নিজস্ব হয় নি। তবু আমাদেরও দৌড় আরম্ভ হল। ওদের ও হাওয়াগাড়ির পায়দানের উপর লাফ দিয়ে আমরা উঠে পড়েছি। আমরাও খর্বকেশিনী খর্ববেশন সাহিত্যকীর্তির টেকনিকের হাল ফ্যাশন নিয়ে গম্ভীরভাবে আলোচনা করি, আমরাও অধুনাতনের স্পর্ধা নিয়ে পুরাতনের মানহানি করতে অত্যন্ত খুশি হই।

 এই সব চিন্তা করেই বলেছিলুম, আমার এ বয়সে খ্যাতিতে আমি বিশ্বাস করি নে। এই মায়ামৃগীর শিকারে বনেবাদাড়ে ছুটে বেড়ানো যৌবনেই সাজে। কেননা সে বয়সে মৃগ যদি-বা নাও মেলে মৃগয়াটাই যথেষ্ট। ফুল থেকে ফল হতেও পারে, না হতেও পারে, তবু আপন স্বভাবকেই চাঞ্চল্যে সার্থক করতে হয় ফুলকে। সে অশান্ত, বাইরের দিকেই তার বর্ণগন্ধের নিত্য উদ্যম। ফলের কাজ অন্তরে, তার স্বভাবের প্রয়োজন অপ্রগল্‌ভ শান্তি। শাখা থেকে মুক্তির জন্যেই তার সাধনা— সেই মুক্তি নিজেরই আন্তরিক পরিণতির যোগে।

 আমার জীবনে আজ সেই ফলেরই ঋতু এসেছে, যে ফল আশু বৃন্তচ্যুতির অপেক্ষা করে। এই ঋতুটির সুযোগ সম্পূর্ণ গ্রহণ করতে হলে বাহিরের সঙ্গে অন্তরের শান্তিস্থাপন চাই! সেই শান্তি খ্যাতি-অখ্যাতির দ্বন্দ্বের মধ্যে বিধ্বস্ত হয়।

৮৯