পাতা:আধুনিক সাহিত্য-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১০১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
রাজসিংহ
৯৭

হঠাৎ পশ্চাৎ হইতে আসিয়া দোলা দিয়াছে—মান-অভিমান লাজলজ্জা বিসর্জন দিয়া ত্রস্ত নায়িকা চকিতবাহুপাশে নায়ককে বাঁধিয়া ফেলিয়াছে। এখন সুদীর্ঘ সুমধুর ভূমিকার সময় নাই।

 এই অকস্মাৎ মৃত্যুর দোলায় সকলেই সজাগ হইয়া উঠিয়াছে এবং আপনার অন্তরবাসী মহাপ্রাণীর আলিঙ্গন অনুভব করিতেছে। কোথায় ছিল ক্ষুদ্র রূপনগরের অন্তঃপুরপ্রান্তে একটি বালিকা, কালক্রমে সে কোন্ ক্ষুদ্র রাজপুতনৃপতির শত রাজ্ঞীর মধ্যে অন্যতম হইয়া অসম্ভব। চিত্রিত লতার উপরে অসম্ভব-চিত্রিত-পক্ষী-খচিত শ্বেতপ্রস্তর-রচিত কক্ষপ্রাচীর-মধ্যে পুরু গালিচায় বসিয়া বঙ্গসঙ্গিনীগণের হাসি-টিটকারিপরিবৃত হইয়া আলবোলায় তামাকু টানিত। সেই পুস্প প্রতিমা সুকুমার সুন্দর বালিকাটুকুর মধ্যে কী এক দুর্বার দুর্ধর্ষ প্রাণশক্তি জাগ্রত হইয়া উঠিল, সে আজ বাঁধমুক্ত বন্যার একটি গর্বোদ্ধত প্রবল তরঙ্গের ন্যায় দিল্লির সিংহাসনে গিয়া আঘাত করিল। কোথায় ছিল মোগল রাজপ্রাসাদের রত্নখচিত রঙমহলে সুন্দরী জেবউন্নিসা—সে সুখের উপর সুখ, বিলাসের উপর বিলাস বিকীর্ণ করিয়া আপনার অন্তরাত্মাকে আরামের পুষ্পরাশির মধ্যে আচ্ছন্ন অচেতন করিয়া রাখিয়াছিল—সেদিনের সেই মৃত্যুদোলায় হঠাৎ তাহার অন্তরশয্যা হইতে জাগ্রত হইয়া তাহাকে কোন্ মহাপ্রাণী এমন নিষ্ঠুর কঠিন বাহুবেষ্টনে পীড়ন করিয়া ধরিল, সম্রাহিতাকে কে সেই সর্বত্রগামী দুঃখের হস্তে সমর্পণ করিল যে দুঃখ প্রাসাদের রাজরাজেশ্বরীকেও কুটিরবাসিনী কৃষককন্যার সহিত এক বেদনাশয্যায় শয়ন করাইয়া দেয়! দস্যু মানিকলাল হইল বীর, রূপমুগ্ধ মোবারক মৃত্যুসাগরে আত্মবিসর্জন করিল, গৃহপিঞ্জরের নির্মলকুমারী বিপ্লবের বহিরাকাশে উড়িয়া আসিল, এবং নৃত্যকুশলা পতঙ্গচপলা দরিয়া সহসা অট্টহাস্যে মুক্তকেশে কালনৃত্যে আসিয়া যোগ দিল।