বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:উনিশে মে- ভাষার সংকট - রণবীর পুরকায়স্থ (২০২১).pdf/৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
উনিশে মে : ভাষার সংকট □ ৪০

কত যে মামা আমার এখন আর নাম মনে নেই। তখন একটু বড় হচ্ছি, দেখেছি হিন্দু মামা আর বাঙাল মামাদের জন্য আলাদা চায়ের কাপ আলাদা হুঁকোর ব্যবস্থা রয়েছে। এ নিয়ে কোনো মালিন্যের ঘটনা ঘটেনি কোনোদিন। মুসলমান বাঙালিকে বরাক উপত্যকায় এখনও কেন বাঙাল বলা হয় জানি না। আমরাও তো বাঙাল।

 কলাভবনের ছাত্র ময়নূল হক বড়ভূঁইয়া ছিল নেহুর শিক্ষক শিলং-এ, শিলচর এলে আমার বাড়িতেই উঠত, থাকত। দিদিমার বাড়াবাড়িতে ডাক্তারের নিদানে মুরগির ডিম খাওয়ানো নিয়ে আতান্তরে পড়েছিলেন যে মা, ডিম সেদ্ধ করে খাওয়াতে পারেননি ছেলেকে, সেই তিনিই ময়নুলকে তাঁর রান্নাঘরে হাতাখুন্তি নাড়াচাড়া করতে দেওয়ায় মোটেও অবাক হইনি। বরং মুগ্ধ হয়েছি ময়নূল আর আমার মায়ের স্বতস্ফুর্ত বন্ধুত্বে। গর্ব হয়েছিল দেশভাগ-বিভাজিত বাঙালিকে দ্বিজাতি ভাবনার অস্পৃশ্যতা থেকে মুক্ত রাখতে পেরেছেন এক মাতা ও পুত্র, এর মধ্যে একজন আমার গর্ভধারিনী অন্যজনও আমার প্রিয়সখা। আশার কিরণ রয়েছে এখানে ওখানে সবখানে, আহরণ করতে যেটুকু সময়। এসব দেখে দেখেই হয়ত দেশভাগ নিয়ে অপর এক ভাষ্য রচনার ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছিল, নির্যাসের সংকেত সদর্থক হয়ে ধরা দিচ্ছিল সেই শৈশব থেকে। দেশভাগ যে ধর্মভাগ নয় এ সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দৃঢ়মূল। কিছু স্বার্থান্বেষী রাজনীতি আর ধর্মের দালালদের সুড়সুড়ির জন্যই যে কাঁটাতারের বন্দোবস্ত এ সত্য বাঙালির বোধগম্য এখন।

 ভাগের আগে অখণ্ড দেশে মানুষ ছিল তুলনায় অজটিল, সাদাসিধে। নিজেদের ধর্মাচরণ করত সংস্কার ও কুসংস্কার সহ, পাশাপাশি থাকতো আত্মীয়তার বন্ধনে, তাই এখনও এই শতবর্ষের দোরগোড়ায় এসে মা আমার ভুলুমামার জন্য চোখের জল ফেলে, প্রিয় পদ রান্না হলে ময়নুলের কথা বলে। হয়তো সংবেদনশীল কথকের বয়ান বলে, শৈশব থেকে হিন্দু মুসলমান এক হয়ে থাকার ছবি দেখেই বড়ো হয়েছি বলে নেতিবাচক চিন্তা স্থান পায় না মনে। হতে পারে তা ফলিত সত্যকে অস্বীকার করে কিন্তু ক্ষতিকারক তো নয়, হোক না স্বপ্ন বোনা। একদিন আসবে বলে অপেক্ষায় থাকাই যায় কারণ একদিন যে ছিল সে সত্য তো গেয়ে গেছেন বাউলসম্রাট শাহ আব্দুল করিম তাঁর গানে,―

‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম
গ্রামের নওজোয়ন হিন্দু মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম
হিন্দু বাড়িতে যাত্রা গান হইত
নিমন্ত্রণ দিত আমরা যাইতাম’

 আবার একদল আছে সহজ সমাধানের যুক্তিবাদী, যারা বলে পাকিস্তান হওয়ার জন্য যারা অত্যচারিত হয়েছে তারা কাছাড়ে এসে হয়েছে কট্টর হিন্দু মানে মুসলমান