পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৬৬
উপেন্দ্রকিশাের রচনাসমগ্র

 রাম বলিলেন, ‘বন্ধু বিভীষণ, তুমি আমার অনেক উপকার করিয়াছ। কিন্তু ভাই ভরত, মা কৌশল্যা, সুমিত্রা আর কৈকেয়ী প্রভৃতিকে দেখিবার জন্য আমার মন বড়ই ব্যস্ত হইয়াছে। তুমি দুঃখ করিও না। আমি আর একদিনও থাকিতে পারিতেছি না, আমাকে এখনই বিদায় দাও।’ তখন সারথি পুষ্পক রথ সাজাইয়া আনিল। রাম সীতা আর লক্ষ্মণের সহিত তাহাতে উঠিয়া, বিভীষণ, সুগ্রীব আর অন্যান্য বানর দিগের নিকট বিদায় চাহিলেন।

 তাহারা সকলে হাতযোড় করিয়া বলিল, ‘দয়া করিয়া আমাদিগকে আপনার সঙ্গে লউন। আমরা অযোধ্যায় গিয়া আপনার অভিষেক দেখিব, আর মা কৌশল্যাকে প্রণাম করিব।’ এই কথায় রাম যার-পর-নাই সুখী হইয়া বলিলেন, ‘তবে তোমরা শীঘ্রই রথে উঠ।’

 তাহারাও রথে উঠিতে আর কিছুমাত্র বিলম্ব করিল না। সুগ্রীব উঠিল, বিভীষণ সপরিবারে উঠিল, অন্যান্য বানরেরা সকলে উঠিল—তাহাদের আনন্দের আর সীমা নাই। তাহাদের সকলকে লইয়া সেই হাঁসে-টানা পুষ্পক রথ শোঁ-শোঁ শব্দে আকাশে উড়িয়া চলিল।

 রথ কিষ্কিন্ধ্যায় আসিলে পর সীতা রামকে বলিলেন, ‘আমার বড় ইচ্ছা হইতেছে যে বানরদিগের বাড়ির মেয়েদিগকে সঙ্গে করিয়া অযোধ্যায় লইয়া যাই। সুতরাং কিষ্কিন্ধ্যার মেয়েরাও অনেকে পুষ্পক রথে উঠিয়া তাঁহাদের সঙ্গে অযোধ্যায় চলিল।

 এইরূপে ক্রমে তাঁহারা ভরদ্বাজ মুনির আশ্রমে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। আর তাহার সঙ্গে সঙ্গে রামের বনে থাকার চৌদ্দ বৎসর ফুরাইল।

 রামকে দেখিয়া ভরদ্বাজ বলিলেন, ‘বাছা, যাইবার সময় তোমাকে দেখিয়া আমার মনে যেমন ক্লেশ হইয়াছিল, আজ তোমাকে আবার দেখিয়া আমার মনে তেমনই আনন্দ হইতেছে। তুমি বর লও।’ রাম বলিলেন, ‘এই বর দিন যে অযোধ্যার পথে সকল গাছে যেন মিষ্ট ফল আর মধু পাওয়া যায়।’

 মুনির বরে তখনই অযোধ্যার পথের গাছ সকল মিষ্ট ফলে আর মধুতে ভরিয়া গেল। বানরেরা কত খাইবে!

 তারপর হনুমানকে ডাকিয়া রাম বলিলেন, ‘হনুমান, তুমি শীঘ্র অযোধ্যায় যাও। সেখানে আমাদের সংবাদ দিবে আর সেখানকার সংবাদও লইয়া আসিবে। পথে শৃঙ্গবের নগরে আমার বন্ধু গুহ থাকেন, তাঁহাকে আমার কথা বলিও। তিনি তোমাকে অযোধ্যার পথ বলিয়া দিবেন।’

 হনুমান তখনই মানুষের বেশ ধরিয়া শোঁ-শোঁ শব্দে আকাশে চলিল। পথে গুহের দেশ। সেখানে রামের সংবাদ দিয়া ভরতের নিকট পৌঁছিতে, তাহার অধিক সময় লাগিল না।

 ভরত তখন নন্দীগ্রামে ছিলেন। অযোধ্যা হইতে এক ক্রোশ দূরে হনুমান তাঁহার দেখা পাইল। তাঁহারও তপস্বীর বেশ, মাথায় জটা আর পরিধানে গাছের ছাল। ফল-মূল খাইয়া থাকেন আর রামের খড়ম দুইখানিকে সম্মুখে রাখিয়া রাজ্যের কাজ করেন।

 হনুমান তাঁহার কাছে আসিয়া হাত যোড় করিয়া বলিল, ‘আপনারা যে রামের জন্য এত দুঃখ করিতেছেন, সেই রাম আপনাদের সংবাদ লইবার জন্য আমাকে পাঠাইয়াছেন। আর দুঃখ করিবেন না, শীঘ্রই তিনি সকলকে লইয়া আসিয়া উপস্থিত হইবেন।’

 এই কথা শুনিয়া ভরত আনন্দে অজ্ঞান হইয়া গেলেন। সুস্থ হইলে পর তিনি হনুমানকে জড়াইয়া ধরিয়া বলিলেন, ‘তুমি দেবতা না মানুষ, দয়া করিয়া আমার এখানে আসিয়াছ?