এ কথায় অগ্নি বরুণের নিকট হইতে গাণ্ডীব নামক ধনুক, অক্ষয় তূণ ও কপিধ্বজ নামক রথ আনিয়া অর্জুনকে দিলেন। সেই রথের উপরে এক ভয়ংকর বানরের মূর্তি থাকাতে উহার ‘কপিধ্বজ’ নাম হয়। অতি আশ্চর্য রথ, বিশ্বকর্মার তৈরি, ঘোড়াগুলি গন্ধর্বের দেশের? আর ধনুকের কথা কি বলিব? নিজে ব্রহ্মা উহা প্রস্তুত করেন। অর্জুন সে ধনুকের গুণ চড়াইবার সময় তাহার ভীষণ শব্দে ত্রিভুবন কাঁপিয়া উঠিল৷
অগ্নি অর্জুনকে এই সকল জিনিস আর কৃষ্ণকে সুদর্শন নামক একখানি চক্র (অর্থাৎ চাকার ন্যায় অস্ত্র) আর কৌমদকী নামক একটি গদা দিলেন। সে চক্রকে কিছুই আটকাইতে পারে না। যাহাকে মারিবে, তাহার আর রক্ষা নাই। চক্র তাহাকে বধ করিয়া আবার হাতে ফিরিয়া আসিবেই আসিবে। অস্ত্র পাইয়া কৃষ্ণ আর অর্জুন অগ্নিকে বলিলেন, “আচ্ছা, তবে এখন আপনি গিয়া বন পোড়াইতে থাকুন। আমরা আপনার সাহায্য করিতেছি৷”
অমনি খাণ্ডব বনের চারিদিকে ভয়ানক আগুন জ্বলিয়া উঠিল। খাণ্ডব দহনেব (অর্থাৎ খাণ্ডব পোড়ানোর) ন্যায় ভয়ানক অগ্নিকাণ্ড খুব কমই হইয়াছে। আগুনের শিখা হড়্-হড়্ ঘড়্-ঘড়্ গর্জনে আকাশ ছইয়া ফেলিল, আর তাহার সঙ্গে সঙ্গে পর্বতাকার কালো ধোঁয়া উঠিয়া দিনকে অমাবস্যার রাত্রির মতো করিয়া দিল। জীব-জন্তু সকলে চিৎকার করিতে করিতে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটিয়াও কৃষ্ণ আর অর্জুনের ভয়ে পলাইতে পারিল না। কৃষ্ণের চক্র এমনি যে, কোনো জন্তু বাহিরে দেখা দিতে না দিষ্ট্রে সে তাহাকে কাটিয়া দুইখান করে। অর্জুনের তীর এমনি যে, ফড়িংটিকে পর্যন্ত উড়িয়া পলাইতে দেয় না। তাঁহার রথ সে সমযে এমনি বেগে সেই বনের চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল যে, উহাদিগকে স্পষ্ট করিয়া দেখিতেই পাওয়া যায় না। কত জন্তু, কত পাখি যে পুড়িয়া মরিল, তাহা ভাবিয়াও শেষ করা যায় না! খাল-বিলের জল টগবগ করিয়া ফুটিতে লাগিল, মাছ, কচ্ছপ, কুমির সকলই সিদ্ধ হইয়া গেল। আগুনের শব্দ আর জন্তুদিগের চিৎকার মিলিয়া ঝড় বজ্রপাত আর সমুদ্রের গর্জনকেও হারাইয়া দিল৷
আগুনের তেজে দেবতারা ভয়ে কাঁপতে কাঁপিতে ইন্দ্রের নিকট গিয়া বলিলেন, “হে ইন্দ্র! আজ অগ্নি কিজন্য পৃথিবীকে ভস্ম করিতে গিয়াছেন? আজ কি সৃষ্টির শেষ দিন উপস্থিত?”
তাঁহাদের কথায় ইন্দ্র অমনি উনপঞ্চাশ পবন আর ঘোরতর কালো মেঘ সকলকে লইযা আগুন নিবাইতে চলিলেন। কিন্তু সে আগুনের তেজে তাঁহার মেঘ-বৃষ্টি আকাশেই শুষিয়া গেল। মেঘ হরিলে ইন্দ্র মহামেঘদিগকে ডাকিলেন—যাহারা মনে করিলে ব্রহ্মাণ্ড তল করিয়া দিতে পারে। কিন্তু সেই সাংঘাতিক মেঘও অর্জুনের বাণে উড়িয়া গেল৷
সেই বনে ইন্দ্রের বন্ধু তক্ষক সাপের বাড়ি। তক্ষক তখন বাড়ি ছিলেন না, কিন্তু তাহার স্ত্রী-পুত্র ছিলেন। তক্ষকের পুত্র অশ্বসেনের মা তো পুড়িয়া মারাই গেলেন। ইহর মধ্যে ইন্দ্র একবার ফাঁকি দিয়া অর্জুনকে অজ্ঞান করিতে পারিয়াছিলেন, তাই রক্ষা নহিলে অশ্বসেনকেও তাঁহার মায়ের সঙ্গেই যাইতে হইত৷
বৃষ্টি করিয়া, বাজ ফেলিয়া, পর্বত ছুঁড়িয়া কিছুতেই ইন্দ্র কৃষ্ণ আর অর্জুনকে জব্দ করিতে পারিলেন না। ইন্দ্রের পর্বত অর্জুনের বাণে ফাটিয়া খণ্ড খণ্ড হইল, তখন বোধ হইল, যেন আকাশের গ্রহগুলি ছুটিয়া পড়িতেছে!