পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/২৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৬৬
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

 তখন যুধিষ্ঠির ভীষ্মকে প্রণাম করিয়া দ্রোণের নিকট গেলেন। দ্রোণের সহিতও তাহার ঐরূপ কথাবার্তা হইল। তাহাকে পরাজয় করিবার উপায়ের কথা জিজ্ঞাসা করিলে দ্রোণ বলিলেন, “আমি বাচিয়া থাকিতে আমাকে পরাজয় করিতে পারিবে না; আমাকে মারিয়া ফেলিবার চেষ্টা কর। সত্যবাদী লোকের মুখে নিতান্ত অপ্রিয় সংবাদ শুনিলেই, আমি অস্ত্র ঘড়িয়া দিব। এমনি সময় আমাকে মারিবার সুযোগ৷”

 সেখান হইতে যুধিষ্ঠির কৃপের নিকট গেলেন। সেখানেও ঐরূপই কথাবার্তা হইল। কৃপ বলিলেন, “আমি অমর, কাজেই আমাকে মারা সম্ভব হইবে না। কিন্তু তথাপি নিশ্চয় তোমার জয় হইবে; আমি সর্বদা তোমাকে আশীর্বাদ করিব৷”

 কৃপের নিকট হইতে যুধিষ্ঠির শল্যের নিকট গেলেন এবং যুদ্ধের সময় কর্ণের তেজ কমাইয়া দিবার কথা তাহাকে স্মরণ করাইয়া দিলেন। শল্য বলিলেন, “আমি তাহা নিশ্চয় করিব। নির্ভয়ে যুদ্ধ কর, তোমার জয় অবশ্য হইবে৷”

 ইহার মধ্যে কৃষ্ণ কর্ণকে বলিলেন, “কর্ণ, ভীষ্ম থাকিতে তো তুমি আর এ পক্ষে যুদ্ধ করিতেছ না, ততদিন আমাদের পক্ষ হইয়া যুদ্ধ কর না কেন?”

 এ কথার উত্তরে কর্ণ বলিলেন, “আমি কিছুতেই দুর্যোধনের অনিষ্ট করিতে পারিব না৷”

 ফিরিয়া আসিবার সময় যুধিষ্ঠির উচ্চৈঃস্বরে কৌরবদিগকে বলিলেন, “এখানে যদি আমার বন্ধু কেহ থাকেন, তবে তিনি আসুন আমরা পরম আদরে তাহাকে আমাদের দলে লইব৷”

 এ কথায় ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র যুযুৎসু আহ্লাদের সহিত বলিলেন, “মহারাজ! আমি আপনার হইয়া যুদ্ধ করিব৷”

 যুধিষ্ঠির বলিলেন, “এস ভাই। তুমি আমাদের হইলে৷”

 তারপর যুদ্ধ আরম্ভ হইল। সে যে কি ভয়ানক যুদ্ধ, তাহা লিখিয়া বুঝাইবার সাধ্য আমার নাই। সে যুদ্ধে বৃষ্টির ধারার ন্যায় ক্রমাগত বাণ পড়িয়াছিল; ঝড়ের সময় যেমন গাছের ফল পড়ে, সেইরূপ করিয়া লোকের মাথা কাটিয়া পড়িয়াছিল, কাটা মানুষের পাহাড় হইতে রক্তের নদী বহিয়া চলিয়াছিল। তখনকার ভয়ানক শব্দের কথা আর কি বলিব! তেমন শব্দ আর কখনো হয় নাই।

 সে সময়ে ভীষ্ম, দ্রোণ, অর্জুন, ভীম প্রভৃতি বড়বড় যোদ্ধাদের বীরত্ব ও ক্ষমতা দেখিয়া, দেবতারা পর্যন্ত আশ্চর্য হইয়া যান। অনেকবারই তাহাদিগকে একথা মানিতে হইয়াছে যে, এমন অদ্ভুত কাজ আমরাও করিতে পারি কি না সন্দেহ। ইহাদের এক একজনে যখন রাগিয়া দাঁড়াইয়াছে, তখন শত যোদ্ধা মিলিয়াও তাহাকে আটকাইতে পারে নাই। হাজার হাজার লোক মারিয়া তবে তাহারা থামিয়াছেন। ভীষ্ম, দ্রোণ বা অর্জুনের এক এক বাণে, অথবা ভীমের এক এক গদাঘাতে, এক একটা হাতি তৎক্ষণাৎ মারা যাইতে ক্রমাগতই দেখা গিয়াছে।

 পাণ্ডবদের পুত্রেরাই[১] কি কম যুদ্ধ করিয়াছিলেন? অভিমন্যুর যুদ্ধ দেখিয়া ভীষ্ম প্রভৃতিরা বারবার বলিয়াছেন, “ঠিক যেন অর্জুন৷” ভীষ্মের সহিত তাহার খুবই যুদ্ধ হয়। তখন ভীষ্ম অনেক চেষ্টা করিয়া তাহার কিছু করিতে পারেন নাই। অভিমন্যু তাহার সমুদয় বাণ কাটিয়া রথের ধ্বজা উড়াইয়া দিয়াছিলেন।

  1. দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র জন্মিয়াছিলেন। তাদের নাম প্রতিবিন্ধ্য, সুতসোম, শ্রুতকর্মা, শতানিক আর শ্রুতসেন। সুভদ্রার এক পুত্র, তার নাম অভিমন্যু।