পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৪৩১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
গল্পমালা
৪৩১

 এ কথায় গুপি জোড়হাতে রাজামশাইকে নমস্কার ক’রে বলল, ‘মহারাজ, দয়া করে আমাদের দুদিনের ছুটি দিতে আজ্ঞা হোক। আমরা আমাদের পিতা-মাতাকে দেখে তাঁদের অনুমতি নিয়ে আপনার রাজধানীতে গিয়ে উপস্থিত হব।’ রাজা বললেন, ‘আচ্ছা এ দুদিন আমরা এই বনেই বিশ্রাম করছি তোমরা তোমাদের মাবাপকে দেখে দুদিন পরে এসে এইখানেই আমাদের পাবে।’

 গুপিকে তাড়িয়ে অবধি তার বাবা তার জন্য বড়ই দুঃখিত ছিল, কাজেই তাকে ফিরে আসতে দেখে তার বড় আনন্দ হল। কিন্তু বাঘা বেচারার ভাগ্যে সে সুখ মেলে নি। তার মা বাপ এর কয়েকদিন আগেই মারা গিয়েছিল। গ্রামের লোকেরা তাকে ঢোল মাথায় ক’রে আসতে দেখেই বলল, ‘ঐ রে! সেই বাঘা বেটা আবাব আমাদের হাড় জ্বালিয়ে মারবে;মাব বেটাকে!’ বাঘা বিনয় ক’রে বলল, ‘আমি খালি আমার মা বাবাকে দেখতে এসেছি দুদিন থেকেই চলে যাব, বাজাব টাজাব না।’ সে কথা কি তাবা শোনে? তারা দাঁত খিঁচিয়ে তার মা বাপের মৃত্যুর কথা বলে এই বড় লাঠি নিয়ে তাকে মারতে এল, সে প্রাণপণে ছুটে পালাতে পালাতে ইট মেরে তার পা ভেঙে মাথা ফাটিয়ে রক্তারক্তি করে দিল।

 গুপি তাদের ঘরের দাওযায় ব’সে তার বাপের সঙ্গে কথা বলছিল, এমন সময় সে দেখল যে বাঘা পাগলের মত হয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ছুটে আসছে; তার কাপড় ছিঁড়ে ফালি ফালি আর রক্তে লাল হয়ে গেছে। অমনি সে তাড়াতাড়ি বাঘার কাছে ছুটে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি হয়েছে? তোমার এ দশা কেন?’ গুপিকে দেখেই বাঘা একগাল হেসে ফেলেছে। তারপব সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘দাদা, বড় বেঁচে এসেছি! মূর্খণ্ডলো আর একটু হলেই আমার ঢোলটি ভেঙে দিয়েছিল। গুপিদের বাড়ি এসে গুপির যত্নে আর তার মা বাপের আদরে বাঘার দুদিন যতটা সম্ভব সুখেই কাটল। দুদিন পরে গুপি তার মা-বাপের কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় ব’লে গেল, ‘তোমরা তয়ের হয়ে থাকবে; আমরা ছুটি পেলেই এসে তোমাদের নিয়ে যাব।’

 তারপর কয়েক মাস চ’লে গিয়েছে। গুপি আব বাঘা এখন হাল্লার রাজার বাড়িতে পরম সুখে বাস করে। দেশ বিদেশে তাদের নাম রটে গিয়েছে—‘এমন ওস্তাদ আর কখনো হয় নি, হবেও না।’ রাজামশাই তাদেব ভারি ভালবাসেন তাদের গান না শুনে একদিনও থাকতে পারেন না। নিজের দুঃখ সুখের কথা সব গুপিব কাছে বলেন। একদিন গুপি দেখল রাজামশায়ের মুখখানি বড়ই মলিন। তিনি ক্রমাগতই যেন কি ভাবছেন, যেন তাঁর কোনো বিপদ হয়েছে। শেষে একবার তিনি গুপিকে বললেন, ‘গুপি বড় মুশকিলে পড়েছি, কি হবে জানি না। শুণ্ডীর রাজা আমার রাজ্য কেড়ে নিতে আসছে।’

 শুণ্ডীর বাজা হচ্ছেন সেই তিনি যিনি গুপি আর বাঘাকে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিলেন। তাঁর নাম শুনেই গুপির মনে একটা চমৎকার মতলব এল। সে তখন বাজামশাইকে বলল, ‘মহারাজ! এর জন্য কোন চিন্তা করবেন না। আপনার এই চকরকে হুকুম দিন, আমি এ থেকে হাসির কাণ্ড ক’রে দেব।’ রাজা হেসে বললেন, ‘গুপি, তুমি গাইয়ে বাজিয়ে মানুষ, যুদ্ধের ধারও ধারে না, তার কিছু বোঝও না। শুণ্ডীর বাজার বড় ভারি ফৌজ, আমি কি তার কিছু করতে পারি?’ গুপি বলল, ‘মহারাজ, হুকুম পেলে একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি। ক্ষতি ত কিছু হবে না।’ রাজা বললেন, ‘তোমরা যা ইচ্ছা তাই তুমি করতে পার।’