বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৬২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মহাভারতের কথা
৬২৯

 মহর্ষি নিদ্রা গেলেন, রাজা আর রানী তাঁহার পদসেবা করিতে লাগিলেন। একুশদিন এইভাবে চলিয়া গেল, একুশদিনের মধ্যে একবারও মহর্ষির নিদ্রাভঙ্গ হইল না। একুশদিনের ভিতরে, রাজা আর রানী একটিবারও মহর্ষির পদসেবা ছাড়িয়া উঠিবার অবসর পাইলেন না। অনাহারের অনিদ্রায় তাঁহাদের এই দীর্ঘকাল কাটিল।

 একুশদিনের পর মহর্ষি শয্যা ত্যাগ পূর্বক, কোন কথা না বলিয়া, বেড়াইতে বাহির হইলেন। রাজা আর রানী ক্ষুধায় অতিশয় কাতর এবং অনিদ্রা আর পরিশ্রমে নিতান্ত ক্লান্ত হইয়াও মুনির সঙ্গে সঙ্গে চলিলেন, কিন্তু মুনি একটিবার তাঁহাদের পানে চাহিয়াও দেখিলেন না।

 কিঞ্চিৎ পরেই রাজা দেখিলেন মুনি আর সেখানে নাই, তিনি আকাশে মিলাইয়া গিয়াছেন। রাজা আর রানী তখন যার পর নাই ভয় এবং দুঃখের সহিত সেই ক্লান্ত শরীরেই প্রাণপণে মুনিকে খুঁজিতে লাগিলেন, কিন্তু কোথাও তাঁহার দেখা পাইলেন না। শেষে নিতান্ত লজ্জিত ও কাতরভবে ঘরে ফিরিয়া আসিবামাত্র দেখিলেন, মহর্ষি পরম সুখে শয্যায় নিদ্রা যাইতেছেন! সুতরাং তখনই আবার তাঁহার পদসেবা আরম্ভ করিতে হইল।

 এইরূপে গেল আর একুশদিন। আমরা হইলে এতদিন অনাহারে অনিদ্রায় বাঁচিয়াই থাকিতে পারিতাম না, পদসেবা করা ত দূরের কথা। কিন্তু রাজা আর রানী এত কষ্ট সহিয়াও কিছুমাত্র বিরক্ত হন নাই, বা সেবার ত্রুটি করেন নাই।

 তারপর মহর্ষি হঠাৎ উঠিয়া বলিলেন, “তৈল আন! স্নান করিব।”

 তখনই মহামূল্য তৈল আনিয়া মুনির গায়ে মাখান হইল। অনেকক্ষণ ধরিয়া মাখান হইলে, মুনি নিজেই উঠিয়া স্নানের ঘরে গেলেন। সেখানে স্নানের আয়োজন সকলই প্রস্তুত ছিল। রাজ মুনিকে স্নান করাইতে গিয়া দেখেন, মুনি নাই! আবার তখনই ঘরে আসিয়া দেখিলেন, মুনি সেখানে বসিয়া আছেন, তাঁহার স্নান হইয়া গিয়াছে! তখন রাজা ভক্তি পূর্বক জোড় হাতে বলিলেন, “ভগবন! অনুমতি করুন, অন্ন আনি।”

 মুনি বলিলেন, “ঘরে যত খাবার আছে, সব লইয়া আইস!”

 তখনই রাজবাটীর সকল ভাত, সকল ব্যঞ্জন, সমস্ত সন্দেশ আনিয়া মুনির সম্মুখ উপস্থিত করা হইল। মুনিবর তাহার উপরে সেই ঘরের সমস্ত মহামূল্য বস্তু, আসন, শয্যা প্রভৃতি স্থাপন করতঃ, তাহাতে অগ্নি প্রদান পূর্বক সেখান হইতে অন্তর্ধান হইলেন।

 তাহাতেও রাজার কিছুমাত্র রাগ হইল না। এইরূপে উনপঞ্চাশ দিন গেল। এই দীর্ঘকালের মধ্যে একদিনও এমন দেখা গেল না যে, রাজার অতি সামান্য পরিমাণেও মুখ ভার হইয়াছে।

 পঞ্চাশদিনের দিন মুনি বলিলেন, “আমাকে রথে বসাইয়া তুমি আর রানী তাহা টানিয়া লইয়া চল, আমি হাওয়া খাইব।”

 তখনই রাজা আর রানীকে জুতিয়া রথ আনা হইল, মুনি অতিশয় তীক্ষ্ণ প্রতোদ (খোঁচা মারিবার জন্য লাঠি) হস্তে তাহাতে উঠিয়া বসিলেন।

 রাজা বলিলেন, “ভগবান! কোন দিকে যাইব?”

 মুনি বলিলেন, “বড় রাস্তার ভিতর দিয়া চল। আর ধনরত্ন যত পার সঙ্গে লও, আমি দান করিব।”

 রাজা আর রানী রাজপথের জনতার ভিতর দিয়া রথ টানিতে লাগিলেন। ভৃত্যগণ দানের