করিত! তাহাকে হারাইয়া আমি কেমন করিয়া বাঁচিব? সে জানিত না যে, তাহার পায়রী সেই গাছের তলাতেই, ব্যাধের হাতে পড়িয়া ঠিক এমনি করিয়া তাহার কথা ভাবিতেছে।
পায়রার কথা শুনিয়া পায়রী এই বিপদের ভিতরেও একটু আনন্দিত হইল, এবং সে সেই পিঞ্জরের ভিতর ইতেই তাহাকে ডাকিয়া বলিল, “ওগো! তুমি আমার জন্য দুঃখ করিও না। এই লোকটি শীতে আর ক্ষুধায় নিতান্ত কাতর হইয়া আমাদের বাড়িতে আসিয়াছে, ইহার দুঃখ দূর করাই হইতেছে এখন আমাদের প্রধান কাজ।
তখন পায়রা ভাবিল, তাইত! এই ব্যাধ এখন আমার অতিথি। ইহার সেবা করা আমার কর্তব্য! এই মনে করিয়া সে ব্যাধকে বলিল, ‘মহাশয়। আপনি যাহাই করিয়া থাকুন, আপনি আমাদের অতিথি—আপনার সেবা করাই আমাদের ধর্ম। এখন বলুন, আপনার জন্য আমি কি করিতে পারি।
এ কথায় ব্যাধ নিতান্ত আশ্চর্য হইয়া বলিল, “বাপু! আমি শীতে বড়ই কষ্ট পাইতেছি। আমার এই কষ্ট যদি দূর করিতে পার, তবে আমার বড় উপকার হয়।”
পায়রা তখনই শুকনো পাতা কুড়াইতে গেল, এবং দেখিতে দেখিতে অনেকগুলি পাতা আনিয়া উপস্থিত করিল।
তারপর দেখা গেল যে, কোথা হইতে এক টুকরা জ্বলন্ত কয়লা ঠোটে করিয়া লইয়া আসিয়াছে। কয়ালাখানি পাতার ভিতরে খুঁজিয়া পায়রা তাহার পাখা দিয়া একটু বাতাস করিতেই, দপ করিয়া আগুন জ্বলিয়া উঠিল। সেই আগুনের তাপে যর পর নাই আরাম পাইয়া, ব্যাধ বলিল, “আঃ বাঁচিলাম। কিন্তু আমার বড় ক্ষুধা হইয়াছে।”
এ কথায় পায়রা অতিশয় চিন্তিত হইল।
পায়রা যেদিন যাহা দরকার, সেইটুকু মাত্র খাবার খুঁজিয়া আনে;তাহাদের সঞ্চয় করিবার রীতি নাই। কাজেই তখন পায়রার ঘরে কণামাত্রও খাবার জিনিস ছিল না। এখন অতিথিকে সে কি খাইতে দিবে?
খানিক চিন্তা করিয়া সে ব্যাধকে বলিল, “আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি আপনার ক্ষুধা দূর করিতেছি।”
এই বলিয়া সে আরো অনেক পাতা আনিয়া খুব বেশি করিয়া আগুন জ্বালিল। তারপর ব্যাধকে বলিল, “মহাশয়, দয়া করিয়া আজ আমাকে আহার করিয়াই আপনার ক্ষুধা দূর করুন।
বলিতে বলিতে সে তিনবার সেই আগুন প্রদক্ষিণ করিয়া, তাহাতে ঝাঁপ দিয়া পড়িল! ব্যাধ এতক্ষণ হতবুদ্ধি হইয়া এই ব্যাপার দেখিতেছিল, পায়রা আগুনে ঝাঁপ দিবামাত্র, সে হায় হায় করিতে করিতে বলিল, “আমি কি করিলাম। আমার মতন মহাপাপী বোধহয় আর ইহ সংসারে নাই। আজ এই পুণ্যবান পক্ষীটি আমাকে বড়ই শিক্ষা দিল। আমি ইচ্ছা করিলে কত সৎকাজ করিতে পারিতাম, তাহার বদলে আমি পাখি মারিয়া বেড়াইতেছি। আমাকে ধিক্ আমার আর বাঁচিয়া কি ফল?”
এই বলিয়া সে সেই পাখিটিকে ছাড়িয়া দিয়া, নিতান্ত বিরক্তভাবে তীর, ধনুক, জাল প্রভৃতি ছুঁড়িয়া ফেলিয়া, কাঁদিতে কাঁদিতে প্রস্থান করিল।
এদিকে পায়রী পায়রার শোক সহ্য না করিতে পারিয়া, পিঞ্জর হইতে মুক্তি পাওয়া মাত্র