চূর্ণ হইয়া যাইত।
যখন জানা গেল যে কংসকে মারিবার লোকের জন্ম হইয়াছে। অমনি সে দুষ্ট এই পূতনাকে ডাকিয়া বলিল যে যত ষণ্ডা-ষণ্ডা খোকা দেখিবে, সকলকেই বধ করিতে হইবে। তদবধি সেই হতভাগিনী কেবলই লোকের ছোট ছোট খোকা মারিয়া বেড়ায়। এমনি করিয়া কত খোকার প্রাণ যে সে হরণ করিল, তাহার সংখ্যা নাই।
নন্দের একটি খোকা হইয়াছে শুনিয়া, এই রাক্ষসী একদিন গোকুলে আসিয়া উপস্থিত হইল। তখন কিন্তু তাহার রাক্ষসী মূর্তি ছিল না। সে এমনি সুন্দর একটি মেয়ে সাজিয়া, এমনি সুন্দর বেশভূষা করিয়া, এমনি মিষ্ট হাসি হাসিয়া আসিয়াছিল যে তাহাকে দেখিয়া সকলে ভাবিল, নিশ্চয় স্বয়ং লক্ষ্মী গোকুলে আসিয়াছেন। সে যেদিকে যায়, সকলে তাহাকে পথ ছাড়িয়া দিয়া জড়সড়ভাবে সরিয়া দাঁড়ায়। দুষ্ট রাক্ষসী ধীরে ধীরে সূতিকা ঘরে ঢুকিল, কেহই তাহাকে নিষেধ করিল না। সে ঘরে যশোদা ছিলেন, বলরামের মা রোহিণীও ছিলেন, তাঁহারা তাহাকে দেখিয়া অবাক হইয়া চাহিয়া রহিলেন।
রাক্ষসী এক পা দু পা করিয়া আসিয়া বিছানার পাশে বসিল ও হাসিতে হাসিতে যেন কতই আদরে, খোকাটিকে কোলে তুলিয়া দুধ খাওয়াইতে লাগিল। যশোদাও কিছু বলিলেন না, রোহিণীও কিছু বলিলেন না, রাক্ষসীর মায়ায় তাঁহারা ভুলিয়া গিয়াছিলেন।
কিন্তু খোকা সে মায়ায় ভোলে নাই। যিনি স্বয়ং বিষ্ণু, রাক্ষসীর মায়া তাঁহার কাছে খাটিবে কেন! রাক্ষসী হাসিতে হাসিতে খোকাকে দুধ খাইতে দিল, খোকা সেই দুধের সঙ্গে অভাগীর প্রাণ অবধি চুষিয়া লইল। তখন সে রাক্ষসী চ্যাঁচাইয়া ছিল, তেমন চীৎকার আর গোকুলের কেহ কোনোদিন শুনে নাই। তাহারা সকলি ভয়ে কাঁপিতে কাঁপিতে তখনই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটিয়া আসিয়া দেখিল কি ভীষণ ব্যাপার। বিকট রাক্ষসী মৃত্যু যন্ত্রণায় ছট্ফট্ করিতেছে, তিন গব্যুতি (ছয় ক্রোশ) পরিমিত স্থানের গাছপালা তাহার দেহের চাপনে চূর্ণ হইয়া গিয়াছে। রাক্ষসীর এক একটা দাঁত যেন একেকটি লাঙ্গলের ফাল, নাকের ছিদ্র যেন পর্বতের গুহা চোখদুটা যেন দুটা কুয়া। সেই রাক্ষসীর বুকের উপর শুইয়া খোকা আনন্দে হাত পা ছুঁড়িতেছে। তখনই সকলে খোকাকে কোলে তুলিয়া লইল। আর ক্রমাগত ষাট্ ষাট্ বলিতে বলিতে কত দেবতার নাম যে করিল তাহার অন্তই নাই।
উহারা যদি জানিত যে সেই খোকাটাই রাক্ষসীটাকে মারিয়াছে, তবে না জানি কত আশ্চর্য হইত।
আর একদিন খোকাকে একটা গাড়ির নীচে, একটি ছোট্ট খাটে শোয়াইয়া রাখা হইয়াছিল। বোধহয় এইভাবে তাহাকে প্রায়ই শোয়াইয়া রাখা হইত। সেদিন বাড়িতে কিসের উৎসব ছিল, সকলে তাহাতেই মত্ত, খোকার কথা আর কাহারও মনে নাই; খোকার কিন্তু এদিকে বড়ই ক্ষুধা হইয়াছে, তাহার দরুন সে পা ছুঁড়িয়া কাঁদিতে আরম্ভ করিয়াছে। পা ছুঁড়িতে ছুঁড়িতে একবার তাহার লাথি লাগিয়া, হাঁড়ি কলসীতে বোঝাই সেই প্রকাণ্ড গাড়িখানা উলটিয়া গেল। সে সব হাঁড়ি কলসী তখনই খান্ খান্ হইয়া ভাঙ্গিয়া গেল। আর শব্দও অবশ্য যেমন তেমন হইল না। তাহা শুনিয়া সকলে ছুটিয়া আসিয়া দেখিল যে খোকা চিৎ হইয়া শুইয়া পা ছুঁড়িতেছে। তাহার পাশে গাড়িখানা উলটান, আর হাঁড়ি কলসী চুর্ণ হইয়া তুমুল কাণ্ড উপস্থিত। এত বড় গাড়ি কি করিয়া উলটিল, এ কথা সকলেই তখন ব্যস্তভাবে