পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৯২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৯২১
বিবিধ প্রবন্ধ

হয়। এই সামান্য সন্দেহটুকুকে মন হইতে তাড়াইয়া দিয়া, তিনি তাহার পিতামাতার নিকট চিঠি লিখিতে বসিলেন। চিঠিতে এই কথাটিও লিখিলেন যে, “এমন গুরুতর সময়ে যদি রোগীকে পরিত্যাগ করে, তবে তাহার কাপুরুষতা হয়।” চিঠি শেষ করিয়া চেয়ার হইতে উঠিবার সময় তাহার মাথা ঘুরিয়া গেল। আরশীতে দেখিলেন যে, তাহার চেহারা বড়ই ফ্যাকাসে হইয়া গিয়াছে। কিন্তু থার্মোমিটার দিয়া জ্বর পাইলেন না; সুতরাং আবার নিশ্চিন্ত হইয়া নিদ্রা গেলেন। পরদিন তাহার শরীরের অবস্থা আরও খারাপ বোধ হইল। এবারে নিজেকে বিশেষরূপে পরীক্ষা করিয়া স্থির করিলেন যে, সম্ভবতঃ তাহার প্লেগই হইয়াছে, তবে আরো দু-একটা লক্ষণ দেখা না দিলে নিশ্চয় বলা যায় না।

 সেই সময়ে তাহার অবস্থা এরূপ, যে তিনি ভাল করিয়া দাড়াইতে পারেন না। কিন্তু এই অবস্থাতেই তিনি তাহার রোগিনীকে দেখিতে চলিলেন। সেখানে ঘণ্টাখানেক থাকিয়া তাহার ঔষধ পথ্যের ব্যবস্থা করিয়া শেষে যখন আর থাকা অসম্ভব হইল, তখন নিজের ঘরে ফিরিলেন। সেখানে আসিয়া নিজের অবস্থা পরীক্ষা করিয়া নিশ্চয় বুঝিলেন যে, তাহার প্লেগ হইয়াছে, আর র্তাহার জীবনের আশা নাই। তখন তিনি তাহার জানালার সারশিতে এইরূপ বিজ্ঞাপন টাঙ্গাইয়া দিলেন—

 “আমার প্লেগ নিউমোনিয়া হইয়াছে। অনুগ্রহ করিয়া আমার নিকট ডাক্তার পাঠাইবেন না; চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই যে আমার মৃত্যু হইবে তাহাতে আর সন্দেহ নাই।”

 এই বিজ্ঞাপন প্রকাশ করিযা ডাক্তার মূলার নিজের রোগের অবস্থা লিখিতে আরম্ভ করিলেন। নিজে যেন ডাক্তার, রোগী যেন আর কেহ, এই রূপ করিয়া পরীক্ষা করেন আর লেখেন। নিজের কথা কিছু লিখিবার না থাকিলে বারিশের পীড়ার রিপোর্ট লেখেন। এই সমস্ত বিবরণ লেখা হইলে, আবার তাহা জানালায় টাঙ্গাইয়া দেওয়া হয়। একজন ধর্মযাজিকা র্তাহার শুশ্রুষা করিতে আসিয়াছেন, তিনি ভিন্ন অন্য কাহাকেও ঘরে ঢুকিতে দেওয়া হয় না।

 যখন আর নিজের লিখিবার ক্ষমতা রহিল না, তখন সেই শুশ্রষাকারিণী ধর্মযাজিকা দ্বারা লেখাইতে লাগিলেন। জিব আওড়াইয়া যাইতে লাগিল, তথাপি ডাক্তার মুলার ক্লান্ত হইলেন না। তিনি বলিলেন, “এগুলি লিখিয়া রাখিলে অন্য ডাক্তারদের কাজে আসিবে।” ক্রমে জ্ঞান লোপ পাইতে লাগিল। কিন্তু ইহার মধ্যে যখনই একটু জ্ঞান হইত, তখনই আবার রোগের অবস্থা লেখাইতেন।

 পক্‌ নামক একটি ডাক্তার তাহাকে চিকিৎসা করিতে আসিলে তিনি তাহাকে ঘরে ঢুকিতে দিতে চাহেন নাই। তিনি বলিয়াছিলেন যে, “আরোগ্যের কোন আশা নাই, না হক আপনি নিজেকে বিপদে ফেলিতেছেন কেন?” যাহা হউক ডাক্তার পকই তাহার চিকিৎসা করিতে লাগিলেন।

 পত্র লেখাইলেন। সেই পত্রে এরূপ ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছিলেন যে, তাহার মৃতদেহ যেন গোর না দিয়া পোড়াইয়া ফেলা হয়, কারণ পোড়াইলে অন্যের বেয়ারাম হইবার আশঙ্কা কম। আর তাহাতে এ কথাও লেখা ছিল, যে তিনি অনেক সময় পিতামাতার মনে ক্লেশ দিয়াছেন, তাহার অপরাধ যেন মার্জনা করেন।

 ডাক্তার পক্‌ আসিলেই মূলার সেই শুশ্রুষাকারিণীর খবর লইতেন, এবং আর কাহারও

উপেন্দ্র—১১৬