পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৯৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৯৬
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

বলিয়াছিলাম দরকার হইলে লইব, আজ সেই দুই বর আমাকে দিতে হইবে। এখন তুমি প্রতিজ্ঞা করিয়া যদি না দাও তবে আমি নিশ্চয় মরিয়া যাইব।’

 নিষ্ঠুর কৈকেয়ী বুঝিয়াছিলেন যে রাজা একবার দিব বলিলে আর প্রাণ গেলেও দিব না’ বলিতে পারিবেন না। তাই এখন সময় বুঝিয়া বলিলেন, রামকে চৌদ্দ বৎসরের জন্য সন্ন্যাসী সাজাইয়া দণ্ডক বনে পাঠাইতে হইবে, আর ভরতকে রাজা করিতে হইবে।”

 হায়, কী নিষ্ঠুর কথা! সেই ভয়ানক কথা শুনিয়াই দশরথ অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া গেলেন। খানিক পরে একটু জ্ঞান হইল। তখন তিনি ভয়ানক রাগের সহিত কৈকেয়ীর দিকে চাহিয়া বলিলেন, ওরে নিষ্ঠুর দুষ্ট কৈকেয়ী, রাম তোর কি করিয়াছে? রাম এমন করিয়া তোর সেবা করে, আর তুই কি না তাহার সর্বনাশ করিতে বসিয়াছিস? কোন দোষে আমি রামকে তাড়াইব? হায় হায়, রাম গেলে আমি বাচিব কেমন করিয়া!'

 এইরূপে কৈকেয়ীকে বিস্তর গালি দিয়া, তারপর দশরথ অতিশয় কাতরভাবে বলিতে লাগিলেন, কৈকেয়ী, তোমার পায়ে পড়ি, এমন কথা মুখে আনিও না! রাম তোমার যেমন সেবা করে, ভরতও তো তেমন করে না। আর বড় ছেলেই যে রাজা হয়, তাহাও তো তুমি জান। আমার রামের কত গুণ! এমন রামকে তোমার জন্য এরূপ নিষ্ঠুর কথা আমি কী করিয়া বলিব?'

 শেষে তিনি আবার বিনয় করিয়া বলিলেন, কৈকেয়ী, আমি বুড়া হইয়াছি, আর বেশীদিন বাঁচিব না। আমাকে দয়া কর! আমার আর যাহা আছে সকলই দিতেছি, তোমার পায়ে পড়ি রামকে ছাড়িবার কথা আমাকে বলিও না!

 দশরথ এইরূপে কত দুঃখ কত মিনতি করিলেন, কতবার অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া গেলেন। কিন্তু নিষ্ঠুর কৈকেয়ীর কিছুতেই দয়া হইল না। তিনি বলিলেন, মহারাজ, একবার বর দিয়া আবার এমন করিয়া কাঁদিতেছ? তুমি তো খুব ধার্মিক দেখিতেছি লোকে শুনিলে বলিবে কী? তুমি যাহাই বল, ও-বর আমি কিছুতেই ছাড়িব না। রামকে যদি তুমি রাজা কর তবে তখনই আমি বিষ খাইয়া মরিব।’

 আহা, বুড়া বেচারার কষ্ট! এমন দুঃখ আর কেহ কি কখন পাইয়াছেঃ রাজা কখনও কাঁদেন, কখনও কৈকেয়ীকে গালি দেন। কখনও বলেন, ‘হায়, কৌশল্যা কী বলিবেন?’ কখনও বলেন, হায় সীতার কী দশা হইবে?’ কখনও আবার অজ্ঞান হইয়া যান। জ্ঞান হইলে আবার কখনও কৈকেয়ীকে বকেন, কখনও রামের জন্য দুঃখ করেন। একবার কৈকেয়ীর পা ধরিতে গেলেন, কিন্তু ততক্ষণ তাঁহার জ্ঞান রহিল না।

 এইরূপ কবিয়া সমস্ত রাত্রি কাটিয়া গেল। কৈকেয়ীর দয়া হওয়া দূরে থাকুক, তিনি আরও বিদ্রুপ করিয়া বলিতে লাগিলেন, মহারাজ, সত্য কথা বল বলিয়া যে বড় অহঙ্কার করিয়া থাক, এখন আমাকে বর দিবার বেলা তাহা কোথায় গেল? রাত ভোর হইয়া গেল, তখনও সেই একই কথা, মহারাজ, প্রতিজ্ঞা করিয়াছ, এখন বর না দিয়া যাইবে কোথায়? শীঘ্র রামকে বনে পাঠাও, আর আমার ভরতকে রাজা কর! ‘

 শেষে দশরথ বুঝিতে পারিলেন যে, আর রামকে বনে না দিয়া উপায় নাই। তখন তিনি বলিলেন, আমি যখন প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, তখন আর কী বলিব? তোর যাহা ইচ্ছা কর। আমি কেবল একটিবার রামকে দেখতে চাই।’