দোকান ছাড়িয়া জুতাওয়ালার দোকানের সামনে চলিয়া যাওয়া কিছুই বিচিত্র নহে। গ্রহগুলিও মনে কর যেন এই চলন্ত ষাঁড়ের মতন, উহারা কখন কোথায় থাকে তাহা ম্যাপে লিখিয়া দেওয়া সম্ভব নহে। তবে ষাঁড়ের সঙ্গে ইহাদের একটা মস্ত তফাত আছে। ষাঁড়ের চলাফেরার একটা হিসাব কিতাবনাই, যখন যেখানে খুশি চলিয়া যায়। কিন্তু গ্রহেরা ভারি আইনজ্ঞলোকের মতন চলে, বেহিসাবী এক পাও ফেলে না। সুতরাং উহাদের কে কখন কোথায় থাকিবে তাহা হিসাব করিয়া স্থির করা যায়। এ সম্বন্ধে এর পরে আরো কথা হইবে। এখন আমরা আকাশের সঙ্গে আর একটু পরিচয় করিতে চেষ্টা করি।
যখন অন্ধকার রাত্রিতে আকাশ খুব পরিষ্কার থাকে, তখন কি আমরা খালি গ্রহ আর নক্ষত্রগুলিকেই দেখিতে পাই? আর কিছুই দেখি না? আর একটা জিনিস আছে, সেটাকে হয়তো তোমাদের কেহ কেহ দেখিয়াও থাকিবে। এই জিনিসটার চেহারা পাতলা সাদা মেঘের মতন, সুতরাং অনেকেই ইহাকে মেঘ মনে করিয়া অগ্রাহ্য করে। আচ্ছা, এখন হইতে এই জিনিসটার একটু খোঁজ লইতে চেষ্টা কর দেখি? দুদিন (দুদিন কেন কয়েক ঘণ্টা) ধরিয়া দেখিলেই বুঝিতে পারিবে যে, আকাশে এমন একটা জিনিস আছে যাহাকে এতদিন হয়তো মেঘ মনে করিয়া আসিয়াছ, অথচ সে মেঘ নহে। মেঘ চলিয়া যায়, কিন্তু উহা নক্ষত্রগুলির ন্যায় স্থির থাকে। মেঘের আকার বদলায়, কিন্তু উহার আকার সর্বদাই একরকম থাকে। এই জিনিসটার নাম ‘ছায়াপথ। আকাশের এক ধার হইতে আর এক ধার পর্যন্ত ছায়াপথ নদীর আকারে বিস্তৃত রহিয়াছে। একবার দেখিলে উহাকে আর ভুলিবার জো নাই।
তোমরা অবশ্য পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ ইত্যাদি দিক চিনিতে পার। যদি না পার তবে—চুপ! অন্য কাহাকেও বলিয়ো না—চুপিচুপি মার কাছে জানিয়া আইস। যাহারা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ‘বোধোদয়’ পড়িয়াছ, তাহারা নিশ্চয় জান যে, যেদিকে ভোরে সূর্য উঠে, সেটা পূর্বদিক। পূর্বদিকে ডান হাত করিয়া দাঁড়াইলে, সম্মুখে উত্তর, বামে পশ্চিম আর পিছনে দক্ষিণ দিক থাকে।
আমাদের সূর্যের মতন কোটি কোটি সুর্য লইয়া ছায়াপথের সৃষ্টি। সেসকল সূর্য কত দূরে, কে বলিবে? আমরা এখানে থাকিয়া তাহাদিগকে স্বতন্ত্রভাবে দেখিতে পাইতেছি না, খালি মোটের উপরে ছায়াপথের স্থানটা একটু ফরসা দেখি।
আকাশের গলায় পৈতার মতন ছায়াপথ তাহার চারিদিক বেষ্টন করিয়া আছে। একবারে আমরা তাহার অর্ধেকের বেশি দেখিতে পাই না, কিন্তু কিছুদিন অপেক্ষা করিলে উহার অপর অর্ধেকও দেখিতে পাইব। আজকাল রাত সাড়ে নয়টার সময় যে অর্ধেককে মাথার উপরে দেখিতে পাও, ক্রমাগত কয়েকদিন ধরিয়া দেখিলে দেখিতে পাইবে যে, উহা আর ঐ সময়ে আমাদের মাথার উপরে থাকে না, কিন্তু আরো পশ্চিমে চলিয়া যায়। কিছুদিন পরে দেখিবে যে সে সন্ধ্যার সময়ই আমাদের মাথার উপরে আসিয়া হাজির হয়। তখন শেষরাত্রিতে আকাশের পূর্বদিকে ছায়াপথের অপর অর্ধেককে দেখিতে পাওয়া যাইবে। আজকাল সেই অর্ধেক দিনেরবেলায় উঠে (অর্থাৎ আকাশের যে ভাগে সূর্য সেই ভাগে সে আছে) বলিয়া আমরা তাহাকে দেখিতে পাই না। শীতকালে সেই অর্ধেক সমস্ত রাত্রি আকাশে থাকিবে। সন্ধ্যাবেলা সে পূর্বদিকে দেখা দিবে, মধ্যরাত্রে আমাদের মাথার উপরে আসিবে, ভোরের বেলা পশ্চিমে অস্ত যাইবে।