পাতা:ঋষি রবীন্দ্রনাথ - অমলেন্দু দাশগুপ্ত (১৯৫৪).pdf/৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঋষি রবীন্দ্রনাথ
৪১

 কেহ বলিয়াছেন, তাঁহাকে জানিয়াছি—অন্তর্হৃদয় আকাশে।

 কেহ বলিয়াছেন, এই দেহপুর মধ্যে যে পদ্ম রহিয়াছে, সেই পদ্মে যে পরম দেবতা শোকহীন পাপহীন গগনসদৃশ অধিষ্ঠিত আছেন, তাঁহাকে জানিয়াছি।

 আবার কেহ বলিয়াছেন, তাঁহাকে জানিয়াছি—যিনি নীলতোয়দমধ্যস্থ বিদ্যুল্লেখার ন্যায় ভাস্বর ও অনুপম। ইত্যাদি॥

 উদ্ধৃত উক্তিসমূহে দেখা যায় যে, ঋষিদের ব্রহ্ম-ঘোষণায় হয় ব্রহ্ম সম্বন্ধে নয় ব্রহ্মদর্শনের ফল সম্বন্ধে অথবা উভয় সম্বন্ধেই কিছু না কিছু ইঙ্গিত বা বিবরণ রহিয়াছে। ব্রহ্ম সম্বন্ধে এই বিবরণকেও আবার দুই শ্রেণীতে ভাগ করিয়া দেখা যায়—তিনি কোথায় এবং তিনি কিরূপে।

 প্রথম ভাগে ঋষিদের ঘোষণায় পাওয়া যায়- তিনি তমসার পারে, তিনি হৃদয়আকাশে, তিনি গুহাহিত ইত্যাদি।

 দ্বিতীয় ভাগে পাওয়া যায়— তিনি বিদ্যুল্লেখের ভাস্বর, তিনি জ্যোতির্ময় তিনি আদিত্যবর্ণ, তিনি গগনসদৃশ ইত্যাদি।

 আর ঋষিদের ঘোষণায় ব্রহ্মদর্শনের ফল সম্বন্ধে পাওয়া যায়—মৃত্যুকে পার হইয়াছি, এই দেহেই অমৃত লাভ করিয়াছি, শোককে অতিক্রম করিয়া বীতশোক হইয়াছি, অবিদ্যাগ্রন্থি ছিন্ন করিয়াছি, ইত্যাদি।

 ঋষিদের উদ্ধৃত ব্রহ্ম-ঘোষণায় পূর্বোক্ত তিনটি বিষয়ের অন্তত কোন একটির পরিচয় বা বিবরণ সর্বদাই পাওয়া যায়, দেখা গিয়াছে। অর্থাৎ ব্রহ্ম কোথায় ব্রহ্ম কিরূপে এবং ব্রহ্মদর্শনের ফল কি—এই তিনটির কোন না কোন একটির বিবরণ ঋষিদের ব্রহ্মদর্শনের প্রসঙ্গে উপনিষদে পাওয়া যায়। ইহাই স্বাভাবিক ও সঙ্গত। যথার্থ ব্রহ্মদর্শন হইলে ‘ব্রহ্মকে দেখিয়াছি’ বলিয়া সে উপলব্ধির বিবরণ শেষ করা কাহারও পক্ষে সম্ভবপর নহে, স্বাভাবিকও নহে।

 এই কারণে রবীন্দ্রনাথও ‘ভূমারে দেখেছি ধ্যানচোখে’ বলিয়া তাঁহার উপলব্ধির বিবরণ শেষ করিতে পারেন নাই, তাই তিনি বলিয়াছেন-“ভূমারে দেখেছি ধ্যানচোখে আলোকের অতীত আলোকে।”

 কোথায় তিনি ব্রহ্মকে দেখিয়াছেন, এই প্রশ্নের উত্তরই ‘আলোকের অতীত আলোকে’—অংশটুকুতে প্রদত্ত রহিয়াছে। ‘আলোকের অতীত আলোকে’,ইহার মধ্যেই ব্রহ্মদর্শনের যথার্থ পরিচয়টুকু পাওয়া যাইতেছে।

 রবীন্দ্রনাথের ঘোষণায় আমরা ব্রহ্মকে পাই—‘আলোকের অতীত আলোকে’ আর বৈদিক ঋষির ঘোষণায় ব্রহ্মকে পাই—‘তমসঃ পরস্তাৎ’। উভয় ঘোষণা একই