পাতা:ঋষি রবীন্দ্রনাথ - অমলেন্দু দাশগুপ্ত (১৯৫৪).pdf/৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঋষি রবীন্দ্রনাথ
৪৩

 —সেখানে সূর্যের ভাতি নাই, চন্দ্রতারকার ভাতি নাই, বিদ্যুৎও সেখানে প্রভান্বিত নহে, অগ্নি সেখানে কোথায়? তিনি প্রকাশমান বলিয়াই তদনুযায়ী নিখিল জগৎ প্রকাশমান, তাঁহারই দীপ্তিতে এই সমুদয় প্রকাশ পায়॥

 অর্থাৎ সে-স্থান কালাতীত, স্থানাতীত, সেখানে তাই সূর্যাদির আলো পৌঁছিতে পারে না, উপনিষদ ইহাই উক্ত স্থান সম্বন্ধে নির্দেশ করিয়াছেন। সেই স্থানটিকেই বুঝাইতে গিয়া উপনিষদ বলিয়াছেন-জ্যোতিষাং জ্যোতি, অর্থাৎ সৃষ্টির সমস্ত জ্যোতিপদার্থ তাঁহারই বা সেই স্থানেরই ছায়ামাত্র।

 লক্ষ্য করিবার বিষয় যে, সে-লোক বা স্থানকে বুঝাইতে গিয়া উপনিষদ ব্রহ্মকেই নির্দেশ করিয়াছেন, অর্থাৎ সে স্থান এবং ব্রহ্ম একই ব্যাপার।

 রবীন্দ্রনাথও ঠিক এই একই কথা বলিয়াছেন—সেই ভূমাকে আমি দেখিয়াছি যিনি আলোকের অতীত আলোক, সেই ব্রহ্মকে আমি দেখিয়াছি যিনি আলোকের অতীত আলোকে।

 প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যাইতেছে যে, পরব্রহ্ম সম্বন্ধে এই তত্ত্বটিই যোগবাশিষ্ঠে অতি মনোরমভাবে বর্ণিত হইয়াছে—

অচন্দ্রাকাগ্নিতায়োঽপি কোঽবিশাশঃ প্রকাশকঃ।
অনেত্রলভ্যাৎ কস্মাৎচ প্রকাশঃ সম্প্রবর্ততি ॥

 —কে চন্দ্র, সূর্য, অগ্নি, নক্ষত্র না হইয়াও নিত্য দীপ্যমান, কে ইন্দ্রিয়ের অগোচর হইয়াও জ্ঞানের প্রকাশক॥

 তিনিই উপনিষদের “জ্যোতিষাং জ্যোতি” এবং রবীন্দ্রনাথের “আলোকের অতীত আলোক।”

 সূর্যের আলোকে প্রকাশিত বস্তুজগতকে দেখিবার জন্য যেমন চক্ষুর দরকার, সেই জ্যোতিষাং জ্যোতি আলোকের অতীত আলোকে দেখিবার জন্যও নিশ্চয় তেমনি চক্ষুর দরকার। উপনিষদ বলেন যে, এই চক্ষুতে তাঁহাকে দেখা যায় না, তাহার জন্য ‘দৈব চক্ষু’ দরকার। রবীন্দ্রনাথও তাই বলিয়াছেন এবং সেই প্রসঙ্গেই তিনি ধ্যানচক্ষুর উল্লেখ করিয়াছেন।

 এখন আমরা নিঃসন্দেহে অভিমত ব্যক্ত করিতে পারি যে, “ধূলির আসনে বসি ভূমারে দেখেছি ধ্যানচোখে আলোকের অতীত আলোকে,” রবীন্দ্রনাথের এই ঘোষণায় প্রমাণিত হয়—তিনি ব্রহ্মজ্ঞ, তাঁহার ব্রহ্মদর্শন হইয়াছে।