পাতা:ঋষি রবীন্দ্রনাথ - অমলেন্দু দাশগুপ্ত (১৯৫৪).pdf/৯৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঋষি রবীন্দ্রনাথ
৯৩

প্রেয়ো বিত্তাৎ প্রেয়োঽন্যস্মাৎ সর্বস্মাদ্ অন্তরতরং যদয়ম।ত্ম”—যেহেতু এই আত্মা অন্তরতর, অন্য সমস্ত বস্তু অপেক্ষা নিকটতর, সেই হেতু ইহা পুত্র হইতে প্রিয়, বিত্ত হইতে প্রিয়, অন্য সমুদয় হইতে প্রিয়।”

 আত্মা বা ব্রহ্মকে সর্ব কিছু হইতে প্রিয় বলার অর্থ, ইনিই “প্রিয়তম”। ব্রহ্মই প্রিয়তম—ইহাই হইল বৃহদারণ্যক উপনিষদের উপদেশ এবং প্রিয়তমের সঙ্গে জীবের যে সম্পর্ক, তাহারই নাম প্রেম। ব্রহ্ম বা ভগবানই যে প্রিয়তম এবং প্রিয়তমের জন্য জীবহৃদয়ের প্রেম যে কি বস্তু বা রস, তাঁহারই পরিচয় গীতাঞ্জলি বহন করিয়া থাকে।

 ইহার পরেই পূর্বোক্ত উপনিষদের এই উপদেশ প্রদত্ত হইয়াছে, ‘আত্মানমেব প্রিয়মুপাসীত’—আত্মাকেই প্রিয়রূপে উপাসনা করিবে।

 এখানেও পূর্বের ন্যায় বলিয়া রাখা যাইতেছে যে, আত্মাকে বা ভগবানকে প্রিয়রূপে পূজা, ভজন, বন্দনা, আস্বাদন ইত্যাদিরই প্রকাশরূপ গীতাঞ্জলি।

 অতঃপর বৃহদারণ্যক উপনিষদের উপদিষ্ট প্রেমতত্ত্ব সম্বন্ধে চরম কথাটি উদ্ধৃত করা যাইতেছে। মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য আপন স্ত্রী মৈত্রেয়ীকে বলিয়াছেন—

 জগতে পতি, পত্নী, পুত্র, ধনসম্পত্তি ইত্যাদি আমাদের প্রিয় হয় কেন? কেনই বা জগৎ এবং তাহার বস্তুসমূহ প্রিয় বোধ হয়? ইহারা কেহই ইহাদের নিজেদের গুণে বা ধর্মে আমাদের প্রিয় হয় না। সর্ব প্রিয়তম যে আত্মা তিনিই ইহাদের সকলের অভ্যন্তরে বা অন্তরে রহিয়াছেন, তাই ইহারা প্রিয় হইয়া থাকে, “আত্মনস্তু কামায় সর্বং প্রিয়ং ভবতি”—আত্মারই কামনায় এই সবকিছু প্রিয় হইয়া থাকে।

 প্রিয়তম এই আত্মা সর্ববস্তুতে সর্বরূপে কিভাবে প্রিয়-প্রকাশ গ্রহণ করিয়াছেন, তাহারই প্রিয় রসাস্বাদন গীতাঞ্জলি, পূর্বের ন্যায় এখানেও উল্লেখ করা যাইতেছে।


 অন্যভাবেও ঔপনিষদিক ভক্তি বা প্রেমতত্ত্বকে দেখা যাইতে পারে। জীবের মুক্তি কামনা রহিয়াছে, মোক্ষের প্রয়াস রহিয়াছে; অপরদিকে এই মুক্তি, মোক্ষ ইত্যাদির জন্য জীবের প্রতি ব্রহ্মের আকর্ষণও রহিয়াছে। নতুবা মুক্তি, মোক্ষ, যোগ ইত্যাদি অর্থহীন হইয়া পড়ে। জীবের প্রতি ব্রহ্মের প্রেম এবং ব্রহ্মের প্রতি জীবের প্রেম, ইহা সত্য বলিয়াই মুক্তি, মোক্ষ ইত্যাদিও সত্য ও সম্ভবপর হইয়া থাকে। এইজন্যই উপনিষদে ঋষির প্রার্থনা—

অসতো মা সদ্গময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়, মৃত্যোর্মামৃতং গময়; রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং তেন মাং পাহি নিত্যম্ ইতাদি॥