পাতা:গল্পগুচ্ছ (চতুর্থ খণ্ড).pdf/১১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ছোটো গল্প
৮৮৯

ঘরের চণ্ডীমণ্ডপে প্রতিষ্ঠিত করব কোন্ দুরাশায়! যথোচিত সমারোহে বড়ো রকমের আত্মহত্যা করবার আয়োজনও যে ঘরে নেই; ঠিক করলুম ন্যাশনাল দুর্গের গোড়া পাকা করতে হবে, যত সময়ই লাগুক। বাঁচতে যদি চাই, আদিম সৃষ্টির হাত দুখানায় গোটাদশেক নখ নিয়ে আঁচড় মেরে লড়াই করা চলবে না। এ যুগে যন্ত্রের সঙ্গে দিতে হবে পাল্লা। হাতাহাতি করার তাল-ঠোকা পালোয়ানি সহজ, বিশ্বকর্মার চেলাগিরি সহজ নয়। পথ দীর্ঘ, সাধনা দুরূহ।

 দীক্ষা নিলুম যন্ত্রবিদ্যায়। আমেরিকায় ডেট্রয়েটে ফোর্ডের মোটর-কারখানায় কোনোমতে ভর্তি হলুম। হাত পাকাচ্ছিলুম কিন্তু শিক্ষা এগচ্ছিল বলে মনে হয় নি। একদিন কী দুর্‌বুদ্ধি ঘটল, মনে হল ফোর্ড্‌কে যদি একটুখানি আভাস দিতে যাই যে নিজের স্বার্থসিদ্ধি আমার উদ্দেশ্য নয়, আমি চাই দেশকে বাঁচাতে, তা হলে ধনকুবের বুঝি বা খুশি হবে, এমন-কি দেবে আমার রাস্তা প্রশস্ত করে। অতি গম্ভীরমুখে ফোর্ড্ বললে, ‘আমার নাম হেন্‌রি ফোর্ড্, পুরোনো পাকা ইংরেজি নাম। কিন্তু আমি জানি আমাদের ইংলন্‌ডের মামাতো ভাইরা অকেজো, ইন্‌এফীসিয়েণ্ট্। তাদের আমি কেজো করে তুলব এই আমার সংকল্প।’ অর্থাৎ অকেজো টাকাওয়ালাকে কেজো করবে কেজো টাকাওয়ালা স্বগোত্রের লাইন বাঁচিয়ে, আমরা থাকব চিরকাল কেজোদের হাতে কাদার পিণ্ড। তারা পুতুল বানাবে। এই দুঃখেই গিয়েছিলুম একদিন সোভিয়েটের দলে ভিড়তে। তারা আর যাই করুক কোনো নিরুপায় মানব-জাতকে নিয়ে পতুলনাচের অর্থকরী ব্যাবসা করে না।

 কিছুদিন চাকা চালিয়ে শেষকালে বুঝলুম যদুবিদ্যাশিক্ষার আরও গোড়ায় যেতে হবে। শুরুতে দরকার যন্ত্রনির্মাণের মালমসলা জোগাড় করার বিদ্যে। কৃতকর্মাদের জন্যেই ধরণী দুর্গম পাতালপরীতে জমা করে রেখেছেন কঠিন খনিজ পিণ্ড। সেইগুলো হস্তগত করে তারাই দিগ্বিজয় করেছে যারা বাহাদুর জাত। আর যাদের চিরকালই অদ্যভক্ষ্য ধনুর্‌গুণ তাদের জন্যেই বাঁধা বরাদ্দ উপরিস্তরের ফল-ফসল শাকসব্‌জি— হাড় বেরিয়ে গেল পাঁজরের, পেটে পিঠে গেল এক হয়ে।

 লেগে গেলাম খনিজবিদ্যায়। এ কথা ভুলি নি যে ফোর্ড্ বলেছেন ইংরেজ জাত অকেজো। তার প্রমাণ আছে ভারতবর্ষে। একদিন ওরা হাত লাগিয়েছিল নীলের চাষে, চায়ের চাষে আর-একদিন। সিভিলিয়ান-দল দফতরখানায় ‘ল অ্যাণ্ড্ অর্ডর’এর জাঁতা চালিয়ে দেশের অস্থিমজ্জা ছাতু করে বানিয়ে তুলেছে বস্তাবন্দী ভালোমানুষি, অতি মোলায়েম। সামান্য কিছু কয়লার আকর ছাড়া ভারতের অন্তর্ভাণ্ডারের সম্পদ উদ্ঘাটিত করতে উপেক্ষা করেছে কিংবা অক্ষমতা দেখিয়েছে। নিংড়েছে বসে বসে পাটের চাষীর রক্ত। জামশেদজি টাটাকে সেলাম করেছি সমুদ্রের ওপার থেকে। ঠিক করেছি আমার কাজ পটকা ছোঁড়া নয়। সিঁধ কাটতে যাব পাতালপুরীর পাষাণপ্রাচীরে। মায়ের আঁচল-ধরা খোকাদের দলে মিশে ‘মা মা’ ধ্বনিতে মন্তর আওড়াব না; আর দেশের যত অভুক্ত অক্ষম রূগ্‌ণ অশিক্ষিত কাল্পনিক-ভয়ে-দিনরাত-কম্পমান দরিদ্রকে সহজ ভাষায় দরিদ্র বলেই জানব — ‘দরিদ্রনারায়ণ’ ব’লে একটা বুলি বানিয়ে তাদের বিদ্রূপ করব না। প্রথম বয়সে একবার বচনের পুতুলগড়া খেলা অনেক খেলেছি। কবি-কারিগরদের কুমোরটলিতে স্বদেশের যে সস্তা রাঙতা-লাগানো প্রতিমা গড়া হয় তার সামনে গদ্গদ ভাষায় অনেক অশ্রুজল ফেলেছি।