পাতা:গল্পগুচ্ছ (চতুর্থ খণ্ড).pdf/৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮৭০
গল্পগুচ্ছ

প্রিন্সিপালের কাছে নালিশ করব।”

 “নালিশ করতে হয় কোরো, তবে অপমানের একটা সংজ্ঞা ঠিক করে দিয়ো। এর মধ্যে কোন্ শব্দটা অপমানের? বলো তো আমি আরও চড়িয়ে দিতে পারি। বলব— হে নিখিলবিশ্বহৃদয়-উন্মাদিনী”—

 রাগে লাল হয়ে সুরীতি দ্রুতপদে চলে গেল। তার পিছন দিকে খুব একটা হাসির ধ্বনি উঠল। ডাক পড়তে লাগল, “ফিরে চাও হে রোষারুণলোচনা, হে যৌবনমদমত্তমাতঙ্গিনী—”

 তার পরের দিন ক্লাস আরম্ভ হবার মুখেই রব উঠল, “হে সরস্বতী-চরণকমলদল-বিহারিণী-গুঞ্জনমত্ত-মধুব্রতা, পূর্ণচন্দ্রনিভাননী”—

 সুরীতি রেগে গিয়ে পাশের ঘরে সুপারিন্‌টেণ্ডেণ্ট্ গোবিন্দবাবুকে বললে, “দেখুন, আমাকে কথায় কথায় অপমান করলে আমি থাকব না।”

 তিনি এসে বললেন, ক্লাসের ছেলেদের, “তোমরা কেন ওকে এত উপদ্রব করছ।”

 নীহার বললে, “এ’কে কি উপদ্রব বলে! যদি কেউ নালিশ করতে পারে, তবে পূর্ণচন্দ্রই করতে পারতেন যে তাঁকে আমি ঠাট্টা করেছি। আমাদের ক্লাসে যোগেশ বলে—ওগুলো বাদ দিয়ে শুধু ওকে নিভাননা বললেই হয়, কেননা কলমের নিভের মতন সুতীক্ষ্ণ ওর মুখ। শুনে বরং আমি বলেছিলুম ‘ছি, এরকম করে বলতে নেই, ওঁরা হলেন বিদুষী’— কথাটা চাপা দিয়েছিলুম। কিন্তু পুর্ণচন্দ্রনিভাননাতে আমি তো দোষের কিছু দেখি নি।”

 ছেলেরা বললে, “আপনি বিচার করে দেখুন, আমরা মনের আনন্দে আউড়ে গিয়েছিলাম—হে সরস্বতীচরণকমলদলবিহারিণী গঞ্জনমত্তমধুব্রতা! প্রথমত কথাটা নিন্দার নয়, দ্বিতীয়ত সেটা যে ওরই প্রতি লক্ষ করে বলা এত বড়ো অহংকার ওর কেন হল। ঘরেতে আরও তো ছাত্রী আছে, তারা তো ছিল খুশি।”

 সাপারিন্‌টেণ্ডেণ্ট্ বললেন, “অস্থানে অসময়ে এ রকম সম্ভাষণগুলো লোকে পরিহাস বলেই নেয়। দরকার কী বলা!”

 “দেখুন সার, মন যখন উতলা হয়ে ওঠে তখন কি সময় অসময়ের বিচার থাকে। তা ছাড়া আমাদের এ সম্ভাষণ যদি পরিহাসই হয়, তা হলে তো এটা কেউ গায়ে না নিয়ে হেসে উড়িয়ে দিতে পারতেন। আর, আপনার কলেজে এত বড়ো বড়ো সব বিদুষী, এঁরা কি পরিহাসের উত্তরে পরিহাস করতেও জানেন না? এদের দন্তরুচিকৌমুদীতে কি হাস্যমাধুরী জাগবে না। তা হলে আমরা সব তৃষিত সুধাপিপাসু পুরুষগুলো বাঁচি কী করে।”

 এই রকম কথা-কাটাকাটির পালা চলত যখন তখন। সুরীতি অস্থির হয়ে উঠল— তার স্বাভাবিক গাম্ভীর্য আর টেঁকে না। সে ঠাট্টা করতে জানে না, অথচ কড়া জবাব করবার ভাষাও তার আসে না। সে মনে-মনে জ্বলে পুড়ে মরে। সুরীতির এই দুর্গতিতে দয়া হয় এমন পুরুষও ছিল ওদের মধ্যে, কিন্তু তারা ঠাঁই পায় না।

 আর-একদিন হঠাৎ কী খেয়াল গেল, যখন সুরীতি কলেজে আসছিল তখন রাস্তার ওপার থেকে নীহার তাকে ডেকে উঠল—‘হে কনকচম্পকদামগৌরী!’

 লোকটা পড়াশুনা করেছে বিস্তর, তার ভাষা শিখবার যেন একটা নেশা ছিল। যখন তখন অকারণে সংস্কৃত আওড়াত, তার ধ্বনিটা লাগত ভালো। পাঠ্য পুস্তকের