পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/১৬০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬৭০
গল্পগুচ্ছ

 সমস্ত বাড়ির, এমন-কি, সমস্ত পাড়ার এই আতঙ্ক আমার বুকের মধ্যে পাথরের মতাে চেপে বসল। সেদিনকার আকাশের যত আলাে এবং জগতের সকল শক্তি যেন বারাে বছরের একটি পাড়াগেঁয়ে মেয়েকে দুইজন পরীক্ষকের দুইজোড়া চোখের সামনে শক্ত করে তুলে ধরবার জন্যে পেয়াদাগিরি করছিল—আমার কোথাও লুকোবার জায়গা ছিল না।

 সমস্ত আকাশকে কাঁদিয়ে দিয়ে বাঁশি বাজতে লাগল—তােমাদের বাড়িতে এসে উঠলম। আমার খুঁৎগুলি সবিস্তারে খতিয়ে দেখেও গিন্নির দল সকলে স্বীকার করলেন, মােটের উপরে আমি সুন্দরী বটে। সে কথা শুনে আমার বড়াে জায়ের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। কিন্তু, আমার রূপের দরকার কী ছিল তাই ভাবি। রূপ-জিনিসটাকে যদি কোনাে সেকেলে পণ্ডিত গঙ্গামৃত্তিকা দিয়ে গড়তেন তা হলে ওর আদর থাকত; কিন্তু, ওটা যে কেবল বিধাতা নিজের আনন্দে গড়েছেন, তাই তােমাদের ধর্মের সংসারে ওর দাম নেই।

 আমার যে রূপ আছে সে কথা ভুলতে তােমার বেশিদিন লাগে নি। কিন্তু আমার যে বুদ্ধি আছে সেটা তােমাদের পদে পদে স্মরণ করতে হয়েছে। ঐ বুদ্ধিটা আমার এতই স্বাভাবিক যে তােমাদের ঘরকন্নার মধ্যে এতকাল কাটিয়েও আজও সে টিঁকে আছে। মা আমার এই বুদ্ধিটার জন্যে বিষম উদ্‌বিগ্ন ছিলেন, মেয়েমানুষের পক্ষে এ এক বালাই। যাকে বাধা মেনে চলতে হবে সে যদি বুদ্ধিকে মেনে চলতে চায় তবে ঠোকর খেয়ে খেয়ে তার কপাল ভাঙবেই। কিন্তু, কী করব বলো। তােমাদের ঘরের বউয়ের যতটা বুদ্ধির দরকার বিধাতা অসতর্ক হয়ে আমাকে তার চেয়ে অনেকটা বেশি দিয়ে ফেলেছেন, সে আমি এখন ফিরিয়ে দিই কাকে। তােমরা আমাকে মেয়ে-জ্যাঠা বলে দুবেলা গাল দিয়েছ। কটু কথাই হচ্ছে অক্ষমের সান্ত্বনা; অতএব সে আমি ক্ষমা করলুম।

 আমার একটা জিনিস তােমাদের ঘরকন্নার বাইরে ছিল, সেটা কেউ তােমরা জান নি। আমি লুকিয়ে কবিতা লিখতুম। সে ছাইপাঁশ যাই হােক-না, সেখানে তােমাদের অন্দরমহলের পাঁচিল ওঠে নি। সেইখানে আমার মুক্তি; সেইখানে আমি আমি। আমার মধ্যে যা-কিছু, তােমাদের মেজোবউকে ছাড়িয়ে রয়েছে সে তােমরা পছন্দ কর নি, চিনতেও পার নি; আমি যে কবি সে এই পনেরাে বছরেও তােমাদের কাছে ধরা পড়ে নি।

 তােমাদের ঘরের প্রথম স্মৃতির মধ্যে সবচেয়ে যেটা আমার মনে জাগছে সে তােমাদের গােয়ালঘর। অন্দরমহলের সিঁড়িতে ওঠবার ঠিক পাশের ঘরেই তােমাদের গােরু থাকে, সামনের উঠোনটুকু ছাড়া তাদের আর নড়বার জায়গা নেই। সেই উঠোনের কোণে তাদের জাবনা দেবার কাঠের গামলা। সকালে বেহারার নানা কাজ; উপবাসী গােরুগুলাে ততক্ষণ সেই গামলার ধারগুলাে চেটে চেটে চিবিয়ে চিবিয়ে খাব্‌লা দিত। আমার প্রাণ কাঁদত। আমি পাড়াগাঁয়ের মেয়ে—তােমাদের বাড়িতে যেদিন নতুন এলম সেদিন সেই দুটি গােরু এবং তিনটি বাছুরই সমস্ত শহরের মধ্যে আমার চিরপরিচিত আত্মীয়ের মতাে আমার চোখে ঠেকল। যতদিন নতুন বউ ছিলুম নিজে না খেয়ে লুকিয়ে ওদের খাওয়াতুম; যখন বড়াে হলুম তখন গােরুর প্রতি আমার প্রকাশ্য মমতা লক্ষ্য করে আমার ঠাট্টার সম্পর্কীয়েরা আমার গােত্র সম্বন্ধে সন্দেহ