হঠাৎ অনেক দিনের শােনা একটা বাউলের গান যতীনের মনে পড়িয়া গেল—
ওরে মন, যখন জাগলি না রে
তখন মনের মানুষ এল দ্বারে।
তার চলে যাবার শব্দ শুনে
ভাঙল রে ঘুম,
ও তাের ভাঙল রে ঘুম অন্ধকারে।
“মাসি, ঘড়িতে ক’টা বেজেছে।”
“ন’টা বাজবে।”
“সবে ন’টা? আমি ভাবছিলুম বুঝি দুটো তিনটে কি ক’টা হবে। সন্ধ্যার পর থেকেই আমার দুপর রাত আরম্ভ হয়। তবে তুমি আমার ঘুমের জন্য অত ব্যস্ত হয়েছিলে কেন।”
“কালও সন্ধ্যার পর এইরকম কথা কইতে কইতে কত রাত পর্যন্ত তােমার আর ঘুম এল না, তাই আজ তােমাকে সকাল-সকাল ঘুমােতে বলছি।”
“মণি কি ঘুমিয়েছে।”
“না, সে তােমার জন্যে মসুরির ডালের সুপ তৈরি ক’রে তবে ঘুমােতে যায়।”
“বলাে কী মাসি, মণি কি তবে—”
“সেই তাে তােমার জন্যে সব পথ্যি তৈরি করে দেয়। তার কি বিশ্রাম আছে।”
“আমি ভাবতুম, মণি বুঝি—”
“মেয়েমানুষের কি আর এ-সব শিখতে হয়। দায়ে পড়লেই আপনি করে নেয়।”
“আজ দুপুরবেলা মৌরলা মাছের যে ঝােল হয়েছিল তাতে বড় সুন্দর একটি তার ছিল। আমি ভাবছিলাম তােমারই হাতের তৈরি।”
কপাল আমার! মণি কি আমাকে কিছু করতে দেয়। তােমার গামছা তােয়ালে নিজের হাতে কেচে শুকিয়ে রাখে। জানে যে, কোথাও কিছু নােংরা তুমি দেখতে পার না। তােমার বাইরের বৈঠকখানা যদি একবার দেখ তবে দেখতে পাবে, মণি দুবেলা সমস্ত ঝেড়ে মুছে কেমন তক্তকে ক’রে রেখে দিয়েছে; আমি যদি তােমার এ ঘরে ওকে সর্বদা আসতে দিতুম তা হলে কি আর রক্ষা থাকত। ও তাে তাই চায়।”
“মণির শরীর বুঝি—”
“ডাক্তাররা বলে, রােগীর ঘরে ওকে সর্বদা আনাগােনা করতে দেওয়া কিছু নয়। ওর মন বড়াে নরম কি না, তােমার কষ্ট দেখলে দুদিনে যে শরীর ভেঙে পড়বে।”
“মাসি, ওকে তুমি ঠেকিয়ে রাখ কী ক’রে।”
“আমাকে ও বড় মানে বলেই পারি। তব, বারবার গিয়ে খবর দিয়ে আসতে হয়—ঐ আমার আর-এক কাজ হয়েছে।”
আকাশের তারাগুলি যেন করুণাবিগলিত চোখের জলের মতাে জ্বল্জ্বল করিতে লাগিল। যে জীবন আজ বিদায় লইবার পথে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে যতীন তাহাকে মনে মনে কৃতজ্ঞতার প্রণাম করিল—এবং সম্মুখে মৃত্যু আসিয়া অন্ধকারের ভিতর হইতে যে দক্ষিণ হাত বাড়াইয়া দিয়াছে যতীন স্নিগ্ধ বিশ্বাসের সহিত তাহার উপরে