পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/২৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
নামঞ্জুর গল্প
৭৫৭

তার উপরে—”

 “আচ্ছা আচ্ছা, সে হবে।”

 শেষকালটা উঠে যাবার সময় বলে গেলেন, “তোমাদের ইনি— বুঝতে পারছ? নাম করব না—ঐ-যে তোমাদের সাহিত্যধুরন্ধর—মস্ত লেখক ব’লে বড়াই— কিন্তু, যা বলো তোমার স্টাইলের কাছে তার স্টাইল যেন ডসনের বুট আর তালতলার চটি।”

 বুঝলেম আমাকে উপরে চড়িয়ে দেওয়াটা উপলক্ষমাত্র, তুলনায় ধুরন্ধরকে নাবিয়ে দেওয়াটাই লক্ষ্য।

 এই গেল আমার ভূমিকা। এইবার আমার কঠোর অভিজ্ঞতার কাহিনী।—


‘সন্ধ্যা’ কাগজ যেদিন থেকে পড়তে শুরু সেইদিন থেকেই আহারবিহার সম্বন্ধে আমার কড়া ভোগ। সেটাকে জেলযাত্রার রিহার্সাল বলা হত। দেহের প্রতি অনাদরের অভ্যাস পাকা হয়ে উঠল। তাই প্রথমবার যখন ঠেললে হাজতে, প্রাণপুরুষ বিচলিত হয় নি। তার পর বেরিয়ে এসে নিজের ’পরে কারও সেবাশুশ্রূষার হস্তক্ষেপমাত্র বর্দাস্ত করি নি। পিসিমা দুঃখবোধ করতেন। তাঁকে বলতেম, “পিসিমা, স্নেহের মধ্যে মুক্তি, সেবার মধ্যে বন্ধন। তা ছাড়া, একের শরীরে অন্য শরীরধারীর আইন খাটানোকে বলে ডাইয়ার্কি, স্বৈরাজ্য— সেইটের বিরুদ্ধে আমাদের অসহযোগ।”

 তিনি নিশ্বাস ছেড়ে বলতেন, “আচ্ছা বাবা, তোমাকে বিরক্ত করব না।”

 নির্বোধ, মনে মনে ভাবতেম বিপদ কাটল।

 ভুলেছিলেম, স্নেহসেবার একটা প্রচ্ছন্ন রূপ আছে। তার মায়া এড়ানো শক্ত। অকিঞ্চন শিব যখন তাঁর ভিক্ষের ঝুলি নিয়ে দারিদ্র্যাগৌরবে মগ্ন তখন খবর পান না যে, লক্ষ্মী কোন্-এক সময়ে সেটা নরম রেশম দিয়ে বুনে রেখেছেন, তার সোনার সুতোর দামে সূর্যনক্ষত্র বিকিয়ে যায়। যখন ‘ভিক্ষের অন্ন খাচ্ছি’ বলে সন্ন্যাসী নিশ্চিন্ত তখন জানেন না যে, অন্নপূর্ণা এমন মসলায় বানিয়েছেন যে, দেবরাজ প্রসাদ পাবার জন্যে নন্দীর কানে কানে ফিস্‌ফিস্ করতে থাকেন। আমার হল সেই দশা। শয়নে বসনে অশনে পিসিমার সেবার হস্ত গোপনে ইন্দ্রজাল বিস্তার করতে লাগল, সেটা দেশাত্মবোধীর অন্যমনস্ক চোখে পড়ল না। মনে মনে ঠিক দিয়ে বসে আছি, তপস্যা আছে অক্ষুণ্ণ। চমক ভাঙল জেলখানায় গিয়ে। পিসিমা ও পুলিসের ব্যবস্থার মধ্যে যে-একটা ভেদ আছে, কোনো রকম অদ্বৈতবুদ্ধি দ্বারা তার সমন্বয় করতে পারা গেল না। মনে মনে কেবলই গীতা আওড়াতে লাগলেম; নিস্ত্রৈগুণ্যো ভব্যর্জুন। হায় রে তপস্বী, কখন যে পিসিমার নানা গুণ নানা উপকরণ-সংযোগে হৃদয়দেশ পেরিয়ে একেবারে পাকযন্ত্রে প্রবেশ করেছে, তা জানতেও পারি নি। জেলখানায় এসে সেই জায়গাটাতে বিপাক ঘটতে লাগল।

 ফল হল এই যে, বজ্রাঘাত ছাড়া আর কিছুতে যে শরীর কাবু হত না সে পড়ল অসুস্থ হয়ে। জেলের পেয়াদা যদি-বা ছাড়লে জেলের রোগগুলোর মেয়াদ আর ফুরোতে চায় না। কখনো মাথা ধরে, হজম প্রায় হয় না, বিকেলবেলা জ্বর হতে থাকে। ক্রমে যখন মালাচন্দন হাততালি ফিকে হয়ে এসেছে তখনো এ আপদগুলো টন্‌টনে হয়ে রইল।

 মনে মনে ভাবি, পিসিমা তো তীর্থ করতে গেছেন, তাই ব’লে অমিয়াটার কি