পাতা:গল্পগুচ্ছ (প্রথম খণ্ড).djvu/১৭০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
১৬৬
গল্পগুচ্ছ

 অবশেষে সম্পূর্ণ হতাশ হইয়া ‘মা’ বলিয়া মস্ত একটা মর্মভেদী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন— প্রতিধ্বনি যেন অতীত কালের আরও অনেক হতাশ্বাস ব্যক্তির নিশ্বাস একত্রিত করিয়া ভাষণ গাম্ভীর্যের সহিত পাতাল হইতে স্তনিত হইয়া উঠিল।

 সর্বাঙ্গে জল কাদা মাখিয়া বৈদ্যনাথ উপরে উঠিলেন।

 জনপূর্ণ কোলাহলময় পৃথিবী তাঁহার নিকটে আদ্যোপান্ত মিথ্যা এবং সেই শৃঙ্খলবদ্ধ ভগ্নঘটের মতো শুন্য বোধ হইল।

 আবার যে জিনিসপত্র বাঁধিতে হইবে, টিকিট কিনিতে হইবে, গাড়ি চড়িতে হইবে, বাড়ি ফিরিতে হইবে, স্ত্রীর সহিত বাকবিতণ্ডা করিতে হইবে, জীবন প্রতিদিন বহন করিতে হইবে, সে তাহার অসহ্য বলিয়া বোধ হইল। ইচ্ছা হইল, নদীর জীর্ণ পাড়ের মত ঝুপ্‌ করিয়া ভাঙিয়া জলে পড়িয়া যান।

 কিন্তু, তবু সেই জিনিসপত্র বাঁধিলেন, টিকিট কিনিলেন, এবং গাড়িও চড়িলেন।

 এবং একদিন শীতের সায়াহ্নে বাড়ির দ্বারে গিয়া উপস্থিত হইলেন। আশ্বিন মাসে শরতের প্রাতঃকালে ঘরের কাছে বসিয়া বৈদ্যনাথ অনেক প্রবাসীকে বাড়ি ফিরিতে দেখিয়াছেন, এবং দীর্ঘশ্বাসের সহিত মনে-মনে এই বিদেশ হইতে দেশে ফিরিবার সুখের জন্য লালায়িত হইয়াছেন— তখন আজিকার সন্ধ্যা স্বপ্নেরও অগম্য ছিল।

 বাড়িতে প্রবেশ করিয়া প্রাঙ্গণের কাষ্ঠাসনে নির্বোধের মতো বসিয়া রহিলেন, অন্তঃপুরে গেলেন না। সর্বপ্রথমে ঝি তাঁহাকে দেখিয়া আনন্দ-কোলাহল বাধাইয়া দিল ছেলেরা ছুটিয়া আসিল, গৃহিণী ডাকিয়া পাঠাইলেন।

 বৈদ্যনাথের যেন একটা ঘোর ভাঙিয়া গেল, আবার যেন তাঁহার সেই পূর্বসংসারে জাগিয়া উঠিলেন।

 শুষ্কমুখে ম্লান হাস্য লইয়া, একটা ছেলেকে কোলে করিয়া, একটা ছেলের হাত ধরিয়া অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলেন।

 তখন ঘরে প্রদীপ জ্বালানো হইয়াছে, এবং যদিও রাত হয় নাই তথাপি শীতের সন্ধ্যা রাত্রির মতো নিস্তব্ধ হইয়া আসিয়াছে।