পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

১৮২ গল্পগুচ্ছ শাসিত প্রথম পরিচ্ছেদ দখিরাম রই এবং ছিদাম রই দুই ভাই সকালে যখন দা হাতে লইয়া জন খাটিতে বাহির হইল তখন তাহদের দই সত্রীর মধ্যে বকবিকি চোঁচামেচি চলিতেছে। কিন্তু, প্রকৃতির অন্যান্য নানাবিধ নিত্যকলরবের ন্যায় এই কলহ-কোলাহলও পাড়াসন্ধ লোকের অভ্যাস হইয়া গেছে। তীব্র কন্ঠস্বর শনিবামাত্র লোকে পরস্পরকে বলে, “ওই রে বাধিয়া গিয়াছে।” অথাৎ, যেমনটি আশা করা যায় ঠিক তেমনিটি ঘটিয়াছে, আজও স্বভাবের নিয়মের কোনোরপে ব্যত্যয় হয় নাই। প্রভাতে পর্বদিকে সন্য’ উঠিলে যেমন কেহ তাহার কারণ জিজ্ঞাসা করে না তেমনি এই কুরিদের বাড়িতে দই জায়ের মধ্যে যখন একটা হৈ-হৈ পড়িয়া যায় তখন তাহার কারণ নির্ণয়ের জন্য কাহারও কোনোরপে কৌতুহলের উদ্রেক হয় না। অবশ্য এই কোন্দল-আন্দোলন প্রতিবেশীদের অপেক্ষা দুই স্বামীকে বেশি পশ* করিত সন্দেহ নাই, কিন্তু সেটা তাহারা কোনোরপে অসুবিধার মধ্যে গণ্য করিত না। তাহারা দই ভাই যেন দীঘ সংসারপথ একটা এক্কাগাড়িতে করিযা চলিয়াছে, দই দিকের দই স্প্রিংবিহীন চাকার অবিশ্রাম ছড়ছড় খড়খড় শব্দটাকে জীবনবথযাত্রার একটা বিধিবিহিত নিয়মের মধ্যেই ধরিয়া লইয়াছে। বরঞ্চ ঘরে যে দিন কোনো শব্দমাত্র নাই, সমস্ত থমথম ছমছম করিতেছে, সে দিন একটা আসন্ন অনৈসগিক উপদ্রবের আশঙ্কা জন্মিত, সে দিন যে কখন কী হইবে তাহা কেহ হিসাব করিয়া বলিতে পারিত না । আমাদের গলে্পর ঘটনা যে দিন আরম্ভ হইল সে দিন সন্ধ্যার প্রাক্কালে দুই ভাই যখন জন খাটিয়া শ্রান্তদেহে ঘরে ফিরিয়া আসিল তখন দেখিল স্তৰ গহ গমাগম করিতেছে। বাহিরেও অত্যন্ত গমট। দই-প্রহরের সময় খুব এক-পশলা ব্যষ্টি হইয়া গিয়াছে। এখনও চারি দিকে মেঘ জমিয়া আছে। বাতাসের লেশমাত্র নাই। বর্ষায় ঘরের চারি দিকে জঙ্গল এবং আগাছাগলো অত্যন্ত বাড়িয়া উঠিয়াছে, সেখান হইতে এবং জলমগ্ন পাটের খেত হইতে সিক্ত উদ্ভিক্তের ঘন গন্ধবাপ চতুদিকে একটি নিশচল প্রাচীরের মতো জমাট হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। গোয়ালের পশ্চাদবতী ডোবাব মধ্য হইতে ভেক ডাকিতেছে এবং ঝিল্লিরবে সন্ধ্যার নিস্তব্ধ আকাশ একেবারে পরিপণ। অদরে বর্ষার পদ্মা নবমেঘচ্ছায়ায় বড়ো সিথর ভয়ংকর ভাব ধারণ করিয়া চলিয়াছে। শস্যক্ষেত্রের অধিকাংশই ভাঙিয়া লোকালয়ের কাছাকাছি আসিয়া পড়িয়াছে। এমনকি যেন তাহাদের নিরপোয় মটির প্রসারিত অগলিগলি শানো একটা-কিছু অন্তিম অবলম্বন অকিড়িযা ধরিবার চেষ্টা করিতেছে। দুখিরাম এবং ছিদাম সেদিন জমিদারের কাছারি-ঘরে কাজ করিতে গিয়াছিল। ও পারের চরে জলিধান পাকিয়াছে। বর্ষায় চর ভাসিয়া যাইবার পবেই ধান কাটিয়া