পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৫৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বজ্ঞেশবরের বজ্ঞ 88 O আমিই আমার আত্মীয়কন্যার সহিত তাঁহার ছেলের বিবাহের চক্ৰান্ত করিতেছি।” অত্যন্ত ব্যস্ত হইয়া তিনি যজ্ঞেশবরকে দেশে পাঠাইলেন, এবং পবোন্ত পারটির সহিত বিবাহের দিন যথাসম্ভব নিকটবতী করিয়া দিলেন। বিভূতিকে ডাকিয়া অভিভাবকমহাশয় পড়াশনা ছাড়া আর-কোনো দিকে মন দিতে বিশেষ করিয়া নিষেধ করিলেন। শনিয়া রাগে বিভূতির জেদ চার গণ বাড়িয়া গেল। বিবাহের আয়োজন উদ্যোগ চলিতেছে এমনসময় একদিন যজ্ঞেশ্বরের খোড়ো ঘরে বিভূতিভূষণ স্বয়ং আসিয়া উপস্থিত। যজ্ঞেশ্বর ব্যস্ত হইয়া কহিলেন, “এসো, বাবা, এসো।” কিন্তু কোথায় বসাইবেন, কাঁ খাওয়াইবেন, কিছুই ভাবিয়া পাইলেন না। এখানে নাটোরের কাঁচাগোল্লা কোথায় । বিভূতিভূষণ যখন নানের পতবে রোয়াকে বসিয়া তেল মাখিতেছেন তখন জ্যাঠাইমা তাহার রজতগিরিনিভ গৌর প্রস্ট দেহটি দেখিয়া মগধ হইলেন। যজ্ঞেশ্বরকে ডাকিয়া কহিলেন, “এই ছেলেটির সঙ্গে আমাদের কমলের বিবাহ হয় না কি।” ভীর যজ্ঞেশ্বর বিসফারিতনেত্ৰে কহিলেন, “সে কি হয়!” জ্যাঠাইমা কহিলেন, “কেন হইবে না। চেষ্টা করিলেই হয়।” এই বলিয়া তিনি বাথানপাড়ার গোয়ালাদের ঘর হইতে ভালো ছানা ও ক্ষীর আনাইয়া বিবিধ আকার ও আয়তনের মোদক-নিমাণে প্রবত্ত হইলেন । মানাহারের পর বিভূতিভূষণ সলজে সসংকোচে নিজের বিবাহের প্রস্তাব উত্থাপন করিলেন। যজ্ঞেশ্বর আনন্দে ব্যাকুল হইয়া জ্যাঠাইমাকে সসংবাদ দিলেন। জ্যাঠাইমা শান্ত মুখে কহিলেন, “তা বেশ হয়েছে, বাপ, কিন্তু তুমি একট ঠান্ডা হও ।” তাঁহার পক্ষে এটা কিছুই আশাতীত হয় নাই। যদি কমলার জন্য এক দিক হইতে কাবুলের আমীর ও অন্য দিক হইতে চীনের সম্রাট তাঁহার বারপথ হইত তিনি আশ্চর্য হইতেন না। ক্ষীণাশ্বাস যজ্ঞেশ্বর বিভূতিভূষণের হাত ধরিয়া বলিতে লাগিলেন, “দেখো বাবা, আমার সকল দিক যেন নষ্ট না হয় ।” বিবাহের প্রস্তাব পাকা করিয়া বিভূতিভূষণ তাঁহার বাপের কাছে আসিয়া উপস্থিত হইলেন । গৌরসন্দর নিজে নিরক্ষর ছিলেন বলিয়া শিক্ষিত ছেলেটিকে মনে-মনে বিশেষ খাতির করিতেন। তাঁহার কোনো আচরণে বা মতে পাছে তাঁহার ছেলের কাছে সরশিক্ষা বা শিষ্টতার অভাব ধরা পড়ে এই সংকোচ তিনি দরে করিতে পারিতেন না। তাঁহার একমাত্র প্রাণাধিক পত্র ষেন বাপকে মনে-মনে ধিক্কার না দেয়, যেন অশিক্ষিত বাপের জন্য তাহাকে লজিত না হইতে হয়, এ চেষ্টা তাঁহার সব দা ছিল। কিন্তু তব যখন শনিলেন, বিভূতি দরিদ্রকন্যাকে বিবাহ করিতে উদ্যত, তখন প্রথমটা রাগ প্রকাশ করিয়া উঠিলেন। বিভূতি নতশিরে চুপ করিয়া রহিল। তখন গৌরসন্দর কিঞ্চিৎ শান্ত হইয়া নিজেকে সংশোধন করিয়া লইয়া কহিলেন, “আমি কি পণের লোভে তোমাকে বিবাহ করিতে বলিতেছি । তা মনে করিয়ো না। নিজের ছেলেকে লইয়া বেহাইয়ের সঙ্গে দরদস্তুর করিতে বসিব, আমি তেমন ছোটোলোক নই। কিন্তু বড়োঘরের মেয়ে চাই।” বিভূতিভূষণ বকাইয়া দিলেন, যজ্ঞেশ্বর সম্প্রাস্তবংশীয়, সম্প্রতি গরিব হইয়াছেন।