পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8२ গল্পগুচ্ছ না, এবং দিলেও তাহার জজের পদপ্রাতিসম্ভাবনা সম্বন্ধে সাধারণের সন্দেহ উপসিথত হইত। কিছুদিন বাদে মন্খে দড়ি দিয়া রাইচরণকে ঘোড়া সাজিতে হইল। এবং মল্ল সাজিয়া তাহাকে শিশর সহিত কুস্তি করিতে হইত— আবার পরাভূত হইয়া ভূমিতে পড়িয়া না গেলে বিষম বিপ্লব বাধিত। এই সময়ে অনকেল পক্ষাতীরবতী এক জিলায় বদলি হইলেন। অনকেল তাঁহার শিশর জন্য কলিকাতা হইতে এক ঠেলাগাড়ি লইয়া গেলেন। সাটিনের জামা এবং মাথায় একটা জরির টুপি, হাতে সোনার বালা এবং পায়ে দইগাছি মল পরাইয়া রাইচরণ নবকুমারকে দই বেলা গাড়ি করিয়া হাওয়া খাওয়াইতে লইয়া যাইত। বর্ষাকাল আসিল। ক্ষধিত পদ্মা উদ্যান গ্রাম শস্যক্ষেত্র এক-এক গ্রাসে মুখে পরিতে লাগিল। বালকোচরের কাশবন এবং বনঝাউ জলে ডুবিয়া গেল। পাড়-ভাঙার অবিশ্রাম ঝাপঝাপ শব্দ এবং জলের গজানে দশ দিক মুখরিত হইযা উঠিল, এবং দ্রুতবেগে ধাবমান ফেনরাশি নদীর তীব্রগতিকে প্রত্যক্ষগোচর করিযা তুলিল । অপরাহে মেঘ করিয়াছিল, কিন্তু কষ্টির কোনো সভাবনা ছিল না। রাইচরণের খামখেয়ালি ক্ষুদ্র প্রভু কিছুতেই ঘরে থাকিতে চাহিল না। গাড়ির উপর চড়িয়া বসিল। রাইচরণ ধীরে ধীরে গাড়ি ঠেলিয়া ধান্যক্ষেত্রের প্রান্তে নদীর তীরে আসিয়া উপস্থিত হইল। নদীতে একটিও নৌকা নাই, মাঠে একটিও লোক নাই – মেঘের ছিদ্ৰ দিয়া দেখা গেল, পরপারে জনহীন বালকোতীরে শব্দহীন দীপ্ত সমারোহের সহিত সযাস্তের আয়োজন হইতেছে। সেই নিস্তব্ধতার মধ্যে শিশু সহসা এক দিকে অঙ্গলি নির্দেশ করিয়া বলিল, “চন্ন, ফ।” অনতিদরে সজল পকিল ভূমির উপর একটি বহৎ কদম্বকক্ষের উচ্চশাখায় গুটিকতক কদম্বফল ফুটিয়াছিল, সেই দিকে শিশরে লব্ধ দষ্টি আকৃষ্ট হইযছিল। দুই-চারিদিন হইল, রাইচরণ কাঠি দিযা বিদ্ধ করিয়া তাহকে কদম্বফলের গাড়ি বানাইয়া দিয়াছিল, তাহাতে দড়ি বধিযা টানিতে এত আনন্দ বোধ হইয়াছিল যে, সেদিন রাইচরণকে আর লাগাম পরিতে হয় নাই ; ঘোড়া হইতে সে একেবারেই সহিসের পদে উন্নীত হইয়াছিল । কাদা ভাঙিয়া ফলে তুলিতে যাইতে চলর প্রবত্তি হইল না -- তাড়াতাড়ি বিপরীত দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিল, “দেখো দেখো ও—ই দেখো পাখি, ওই উড়ে—এ গেল। আয় রে পাখি, আয় আয় ।” এইরুপ অবিশ্রান্ত বিচিত্র কলরব করিতে করিতে সবেগে গাড়ি ঠেলিতে লাগিল । কিন্তু যে ছেলের ভবিষ্যতে জজ হইবার কোনো সম্ভাবনা আছে তাহাকে এরপে সামান্য উপায়ে ভুলাইবার প্রত্যাশা করা ব্যথা— বিশেষত চারি দিকে দণ্টি-আকর্ষণের উপযোগী কিছই ছিল না এবং কাল্পনিক পাখি লইযা অধিকক্ষণ কাজ চলে না। বাইচরণ বলিল, “তবে তুমি গাড়িতে বসে থাকো, আমি চট করে ফলে তুলে আনছি। খবরদার, জলের ধারে যেযো না।” বলিয়া হটির উপর কাপড় তুলিয়া কদম্ববক্ষের অভিমুখে চলিল। কিন্তু ওই-যে জলের ধারে যাইতে নিষেধ করিয়া গেল, তাহাতে শিশরে মন কদম্বফল হইতে প্রত্যাবত্ত হইয়া সেই মহেতেই জলের দিকে ধাবিত হইল। দেখিল,