পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৬২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

や > げ গল্পগুচ্ছ ළු এই সময়ে থানাগড়ের বাবদের এক ছেলে এক বাইসিকল কিনিয়া আনিয়া চড়া অভ্যাস করিতেছিল। রসিক সেটাকে লইয়া অতি অপেক্ষণের মধ্যেই এমন আয়ত্ত করিয়া লইল যেন সে তাহার নিজেরই পায়ের তলাকার একটা ডানা। কিন্তু, কী চমৎকার, কী স্বাধীনতা, কী আনন্দ! দীরত্বের সমস্ত বাধাকে এই বাহনটা যেন তীক্ষা সদশনচক্রের মতো অতি অনায়াসেই কাটিয়া দিয়া চলিয়া যায়। ঝড়ের বাতাস যেন চাকার আকার ধারণ করিয়া উন্মত্তের মতো মানুষকে পিঠে করিয়া লইয়া ছোটে। রামায়ণ-মহাভারতের সময় মানুষে কখনো কখনো দেবতার অপত্র লইয়া যেমন ব্যবহার করিতে পাইত এ যেন সেইরকম । রসিকের মনে হইল, এই বাইসিকল নহিলে তাহার জীবন ব্যথা। দাম এমনই কী বেশি। এক-শো প’চিশ টাকা মাত্ৰ ! এই এক-শো প’চিশ টাকা দিয়া মানুষ একটা নতন শক্তি লাভ করিতে পারে— ইহা তো সস্তা। বিষ্ণর গরুড়বাহন এবং সয্যের অর্ণসারথি তো সন্টিকতাকে কম ভোগ ভোগায় নাই, আর ইন্দ্রের উচ্চৈঃশ্রবার জন্য সমদ্রমন্থন করিতে হইয়াছিল— কিন্তু এই বাইসিক্যুলটি তাহার পথিবীজয়ী গতিবেগ সতব্ধ করিয়া কেবল এক-শো প“চিশ টাকার জনা দোকানের এক কোণে দেয়াল ঠেস দিয়া প্রতীক্ষা করিয়া আছে। দাদার কাছে রসিক আর-কিছু চাহিবে না পণ করিয়াছিল, কিন্তু সে পণ রক্ষা হইল না। তবে চাওয়াটার কিছু বেশ পরিবতন করিয়া দিল। কহিল, “আমাকে এক-শো পাঁচশ টাকা ধার দিতে হইবে।” বংশীর কাছে রসিক কিছুদিন হইতে কোনো আবদার করে নাই, ইহাতে শরীরের অসখের উপর আর-একটা গভীরতর বেদনা বংশীকে দিনরাতি পীড়া দিতেছিল। তাই রসিক তাহার কাছে দরবার উপস্থিত করিবামারই মাহতের জন্য বংশীর মন নাচিয়া উঠিল; মনে হইল, দীর হোকগে ছাই, এমন করিয়া আর টানাটানি করা যায় না— দিয়া ফেলি। কিন্তু বংশ ? সে যে একেবারেই ডোবে । এক-শো প’চিশ টাকা দিলে আর বাকি থাকে কণী । ধার! রসিক এক-শো প’চিশ টাকা ধার শাধিবে! তাই যদি সম্ভব হইত তবে তো বংশী নিশ্চিত হইয়া মরিতে পারিত। বংশী মনটাকে একেবারে পাথরের মতো শক্ত করিয়া বলিল, “সে কি হয়। এক-শো পাঁচশ টাকা আমি কোথায় পাইব ।” রসিক বন্ধদের কাছে বলিল, “এ টাকা যদি না পাই তবে আমি বিবাহ করিবই না।” বংশীর কানে যখন সে কথা গেল তখন সে বলিল, “এও তো মজা মন্দ নয় । পাত্রীকে টাকা দিতে হইবে, আবার পারকে না দিলেও চলিবে না। এমন দায় তো আমাদের সাত পরিষের মধ্যে কখনো ঘটে নাই।” রসিক সপেষ্ট বিদ্রোহ করিয়া তাঁতের কাজ হইতে অবসর লইল। জিজ্ঞাসা করিলে বলে, “আমার অসুখ করিয়াছে।” তাঁতের কাজ না করা ছাড়া তাহার আহারবিহারে অসখের অন্য কোনো লক্ষণ প্রকাশ পাইল না। বংশী মনে মনে একটা অভিমান করিয়া বলিল, “থাক, উহাকে আমি আর কখনো কাজ করিতে বলিব না।”