পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৭৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Q8C・ গল্পগুচ্ছ কিন্তু, এ কী আশ্চয’। সিতাংশ; যাকে ক্ষণকালের ফাঁক দিয়ে দেখেছে আজ আট বছরের ঘনিষ্ঠতার পর এই পরের চিঠিগুলির ভিতর দিয়ে তাকে প্রথম দেখলাম। আমার চোখের উপরকার ঘামের পদৰ্ণ কত মোটা পদৰ্ণ না জানি! পরোহিতের হাত থেকে অনিলাকে আমি পেয়েছিলাম, কিন্তু তার বিধাতার হাত থেকে তাকে গ্রহণ করবার মল্যে আমি কিছুই দিই নি। আমি আমার দ্বৈতদলকে এবং নব্যন্যায়কে তার চেয়ে অনেক বড়ো করে দেখেছি। সুতরাং, যাকে আমি কোনোদিনই দেখি নি, এক নিমেষের জন্যও পাই নি, তাকে আর-কেউ যদি আপনার জীবন উৎসগ করে পেয়ে থাকে তবে কী বলে কার কাছে আমার ক্ষতির নালিশ করব । শেষ চিঠিখানা এই— বাইরে থেকে আমি তোমার কিছুই জানি নে, কিন্তু অন্তরের দিক থেকে আমি দেখেছি তোমার বেদনা। এইখানে বড়ো কঠিন আমার পরীক্ষা । আমার এই পর্যষের বাহ নিশ্চেষ্ট থাকতে চায় না। ইচ্ছা করে, বগামতের সমস্ত শাসন বিদীণ করে তোমাকে তোমার জীবনের ব্যথতা থেকে উদ্ধার করে আনি । তার পরে এও মনে হয়, তোমার দুঃখই তোমার অন্তয"মীর আসন। সেটি হরণ করবার অধিকার আমার নেই। কাল ভোরবেলা পৰ্যন্ত মেয়াদ নিয়েছি। এর মধ্যে যদি কোনো দৈববাণী আমার এই বিধা মিটিয়ে দেয় তা হলে যা হয় একটা কিছু হবে । বাসনার প্রবল হাওয়ায় আমাদের পথ চলবার প্রদীপকে নিবিয়ে দেয । তাই আমি মনকে শান্ত রাখব— একমনে এই মন্ত্র জপ করব যে, তোমার কল্যাণ হোক । বোঝা যাচ্ছে, বিধা দর হয়ে গেছে— দজেনার পথ এক হয়ে মিলেছে। মাঝের থেকে সিতাংশর লেখা এই চিঠিগুলি আমারই চিঠি হয়ে উঠল— ওগুলি আজ আমারই প্রাণের স্তবমন্ত্র । কতকাল চলে গেল, বই পড়তে আর ভালো লাগে না । অনিলকে একবার কোনোমতে দেখবার জন্যে মনের মধ্যে এমন বেদনা উপস্থিত হল, কিছুতেই সিথর থাকতে পারলাম না। খবর নিয়ে জানলাম, সিতাংশ তখন মসরি-পাহাড়ে। সেখানে গিয়ে সিতাংশনকে অনেকবার পথে বেড়াতে দেখেছি, কিন্তু তার সঙ্গে তো অনিলকে দেখি নি। ভয় হল, পাছে তাকে অপমান করে ত্যাগ করে থাকে। আমি থাকতে না পেরে একেবারে তার সঙ্গে গিয়ে দেখা করলাম। সব কথা বিস্তারিত করে লেখবার দরকার নেই। সিতাংশ বললে, “আমি তাঁর কাছ থেকে জীবনে কেবল একটিমাত্র চিঠি পেয়েছি—সেটি এই দেখন।” এই বলে সিতাংশ তার পকেট থেকে একটি ছোটো এনামেল-করা সোনার কাড'-কেস খালে তার ভিতর থেকে এক-টুকরো কাগজ বের করে দিলে। তাতে লেখা আছে, “আমি চললাম, আমাকে খুজতে চেষ্টা কোরো না। করলেও খোঁজ পাবে না।’ সেই অক্ষর, সেই লেখা, সেই তারিখ, এবং যে নীলরঙের চিঠির কাগজের অধোঁকখানা আমার কাছে এই টুকরোটি তারই বাকি অর্ধেক। আষাঢ় ১৩২৪