পাতা:গোপীচন্দ্র (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ফিরিলেন। তাহার পরই নাপিত আনিবার আয়োজন। রাণীদিগের বাধা ও উৎকোচ সত্ত্বেও নাপিতকে ক্ষুর লইয়া হাজির হইতে হইল। তাহার পর ময়নামতীয় তত্ত্বাবধানে দেব ও সিদ্ধাগণের সমক্ষে রাজাকে যোগী করা হইল। তাঁহার কর্ণচ্ছেদ হইল, ডোর, কৌপীন ইত্যাদি সাজ হইল; তিনি ময়নামতী কর্ত্তৃক গোরক্ষনাথের শিষ্য হাড়িপার হস্তে সমর্পিত হইলেন। হাড়ীর আদেশে রাজা জননীর মহলে ভিক্ষা করিতে গিয়া “কদুর পাতায়।” খাইয়া আসিলেন। ময়নামতী তাঁহার বুলিতে বার কাহন কড়ি দিলেন। অতঃপর হাড়ি রাজাকে রাণীদের মহলে গিয়া ভিক্ষা আনিতে আদেশ দিলেন। ইহাতে নির্ব্বাপিত অগ্নি জ্বলিয়া উঠিল, অদুনা ও পদুনা রাণী অনেক কাকুতি মিনতি করিলেন, সঙ্গে যাইবার জন্য অস্থির হইলেন এবং বিদেশে তাঁহারা যেরূপ সেবা করিবেন, তাহা বিবৃত করিতে লাগিলেন। রাজা এ প্রলোভনে মুগ্ধ হইলেন না। তিনি পথে নানা বিপদের উল্লেখ করিলেন, কিন্তু রাণীরা তাহাও উপেক্ষা করিতে প্রস্তুত। তাঁহারা ডোর কৌপীন পরিয়া, সম্মুখের দুইটি করিয়া দাঁত ভাঙ্গিয়া, মস্তক মুণ্ডন করিয়া, ভিক্ষার ঝুলি লইয়া রাজার পশ্চাতে যাইবার জন্য অনুমতি চাহিলেন, হাড়িসিদ্ধার ভীষণ কাঁথার ভয়ও তাঁহাদিগকে নিবৃত্ত করিতে পারিল না। রাজা কিন্তু কিছুতেই স্ত্রীলোক সঙ্গে লইয়া যাইবেন না। রাণীদ্বয় একটি পুত্র চাহিলেন। রাজা বনে যাইতেছেন, পুত্র পাইবেন কোথায়? স্বয়ং পুত্র হইবার প্রস্তাব করিলেন। রাণীরা তখন ছুরিকা দ্বারা আত্মহত্যা করিলেন। রাজার মিনতিতে হাড়িসিদ্ধা ধূলাপড়া দিয়া রাণীদিগকে বাঁচাইয়া দিলেন। কোন কোন গায়কের মতে তিনি এই সময়ে একটু রসিকতা করিয়া অদুনার মুণ্ড পদুনার স্কন্ধে, এবং পদুনার মুণ্ড অদুনার স্কন্ধে চাপাইয়া দিলেন।[১] রাণীরা এই অলৌকিক ঘটনার পর স্বামীকে হাড়ির হস্তে ছাড়িয়া দিলেন। নবীন রাজার বৈরাগ্যে রাজ্যময় সকলে কান্দিতে লাগিল। রাজার অনুপস্থিতি-কালে রাজপুরীর বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য বার জায়গায় চৌকী, ও তের জায়গায় থানা বসান হইল, “রামজাল” ও “ব্রহ্মজালে” পুরী বেষ্টিত হইল। বার বৎসর পর্য্যন্ত কোনও পুরুষ পুরীতে প্রবেশ করিতে পরিবে না, এই আদেশ প্রচারিত হইল। সত্যের অন্ন, সত্যের পাশা এবং দামামা গৃহে লম্বিত রাখিয়া গোপীচন্দ্র হাড়িগুরুর সহিত সন্ন্যাসে চলিলেন। খেতুয়া রাজ প্রতিনিধি হইল এবং বাজে রাণীগুলিকে (অদুনা ও পদুনা ব্যতীত) হস্তগত করল। হাড়ি গুরু রাজাকে রাস্তায় বিস্তর লাঞ্ছনা দিলেন। তাঁহার ঝুলির ভার বৃদ্ধি করিয়া দিলেন, বৃহৎ অরণ্য সৃষ্টি করিয়া রাজার পথশ্রমের মাত্রা বাড়াইয়া দিলেন। কণ্টকে রাজার শরীর বিদীর্ণ হইল, রাজা কাতর কণ্ঠে সূর্য্যদেবের মুখ দেখিতে চাহিলেন।

  1. সুখের বিষয় উভয়েই এক পতির সম্পত্তি, সুতরাং বেতালের প্রশ্ন করিবার অবসর ঘটিল না।