পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২২২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তো তাহার একলার ছিল না, বিনয় তাহাকে এমনি উত্তেজিত করিয়া তুলিত যে আত্মসংবরণ করা তাহার পক্ষে অসম্ভব হইত। সেই শশিমুখী আজ যখন বিনয়কে দেখিয়া তাড়াতাড়ি ঘর ছাড়িয়া পলাইয়া গেল তখন আনন্দময়ী হাসিলেন, কিন্তু সে হাসি সুখের হাসি নহে।

 বিনয়কেও এই ক্ষুদ্র ঘটনায় এমন আঘাত করিল যে, সে কিছুক্ষণের জন্য চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। বিনয়ের পক্ষে শশিমুখীকে বিবাহ করা যে কতখানি অসংগত তাহা এইরূপ ছোটোখাটো ব্যাপারেই ফুটিয়া উঠে। বিনয় যখন সম্মতি দিয়াছিল তখন সে কেবল গোরার সঙ্গে তাহার বন্ধুত্বের কথাই চিন্তা করিয়াছিল, ব্যাপারটাকে কল্পনার দ্বারা অনুভব করে নাই। তা ছাড়া আমাদের দেশে বিবাহটা যে প্রধানত ব্যক্তিগত নহে, তাহা পারিবারিক, এই কথা লইয়া বিনয় গৌরব করিয়া কাগজে অনেক প্রবন্ধ লিখিয়াছে; নিজেও এ সম্বন্ধে কোনো ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা বিতৃষ্ণাকে মনে স্থানও দেয় নাই। আজ শশিমুখী যে বিনয়কে দেখিয়া আপনার বর বলিয়া জিব কাটিয়া পলাইয়া গেল ইহাতে শশিমুখীর সঙ্গে তাহার ভাবী সম্বন্ধের একটা চেহারা তাহার কাছে দেখা দিল। মুহূর্তের মধ্যে তাহার সমস্ত অন্তঃকরণ বিদ্রোহী হইয়া উঠিল। গোরা যে তাহার প্রকৃতির বিরুদ্ধে তাহাকে কতদূর পর্যন্ত লইয়া যাইতেছিল ইহা মনে করিয়া গোরার উপরে তাহার রাগ হইল, নিজের উপরে ধিক্কার জন্মিল, এবং আনন্দময়ী যে প্রথম হইতেই এই বিবাহে নিষেধ করিয়াছেন তাহা স্মরণ করিয়া তাঁহার সূক্ষ্ণদর্শিতায় তাঁহার প্রতি বিনয়ের মন বিস্ময়মিশ্রিত ভক্তিতে পূর্ণ হইয়া উঠিল।

 আনন্দময়ী বিনয়ের মনের ভাবটা বুঝিলেন। তিনি অন্য দিকে তাহার মনকে ফিরাইবার জন্য বলিলেন, “কাল গোরার চিঠি পেয়েছি বিনয়।”

 বিনয় একটু অন্যমনস্ক ভাবেই কহিল, “কি লিখেছে?”

 আনন্দময়ী কহিলেন, “নিজের খবর বড়ো একটা কিছু দেয় নি। দেশের ছোটোলোকদের দুর্দশা দেখে দুঃখ করে লিখেছে। ঘোষপাড়া বলে কোন্‌-এক গ্রামে ম্যাজিস্ট্রেট কী সব অন্যায় করেছে তারই বর্ণনা করেছে।”

২১২