পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪১৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কুসংস্কারের ভারতবর্ষ, আমার এই পৌত্তলিক ভারতবর্ষ। তুমি এর সঙ্গে যদি ভিন্ন হতে চাও তবে আমার সঙ্গেও ভিন্ন হবে।”

 এই বলিয়া গোরা উঠিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া ছাতে বেড়াইতে লাগিল। বিনয় চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। বেহারা আসিয়া গোরাকে খবর দিল অনেকগুলি বাবু তাহার সঙ্গে দেখা করিবার জন্য বাহিরে অপেক্ষা করিতেছে। পলায়নের একটা উপলক্ষ পাইয়া গোরা আরাম বোধ করিল; সে চলিয়া গেল।

 বাহিরে আসিয়া দেখিল, অন্যান্য নানা লোকের মধ্যে অবিনাশও আসিয়াছে। গোরা স্থির করিয়াছিল অবিনাশ রাগ করিয়াছে। কিন্তু, রাগের কোনো লক্ষণ প্রকাশ পাইল না। সে আরও উচ্ছ্বসিত প্রশংসাবাক্যে তাহার গতকল্যকার প্রত্যাখ্যান-ব্যাপার সকলের কাছে বর্ণনা করিতেছিল। সে কহিল, “গৌরমোহনবাবুর প্রতি আমার ভক্তি অনেক বেড়ে গেছে; এতদিন আমি জানতুম উনি অসামান্য লোক, কিন্তু কাল জানতে পেরেছি উনি মহাপুরুষ। আমরা কাল ওঁকে সম্মান দেখাতে গিয়েছিলুম; উনি যেরকম প্রকাশ্যভাবে সেই সম্মানকে উপেক্ষা করলেন সেরকম আজকালকার দিনে কজন লোক পারে! এ কি সাধারণ কথা!”

 একে গোরার মন বিকল হইয়া ছিল, তাহার উপরে অবিনাশের এই উচ্ছ্বাসে তাহার গা জ্বলিতে লাগিল; সে অসহিষ্ণু হইয়া কহিল, “দেখো, অবিনাশ, তোমরা ভক্তির দ্বারাই মানুষকে অপমান কর— রাস্তার ধারে আমাকে নিয়ে তোমরা সঙের নাচন নাচাতে চাও, সেটা প্রত্যাখ্যান করতে পারি এতটুকু লজ্জাশরম তোমরা আমার কাছে প্রত্যাশা কর না! একেই তোমরা বল মহাপুরুষের লক্ষণ! আমাদের এই দেশটাকে কি তোমরা কেবলমাত্র একটা যাত্রার দল বলে ঠিক করে রেখেছ? সকলেই পালা নেবার জন্যে কেবল নেচে বেড়াচ্ছে! কেউ এতটুকু সত্য কাজ করছে না। সঙ্গে যোগ দিতে চাও ভালো, ঝগড়া করতে চাও সেও ভালো, কিন্তু দোহাই তোমাদের, অমন করে বাহবা দিয়ো না।”

৪০৪