পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৭০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ভাববে না?”

 বিনয় কহিল, “হিন্দুসমাজ তো আছে।”

 পরেশবাবু কহিলেন, “হিন্দুসমাজ তোমাদের ভার যদি না নেয়, যদি না স্বীকার করে?”

 বিনয় আনন্দময়ীর কথা স্মরণ করিয়া কহিল, “তাকে স্বীকার করাবার ভার আমাদের নিতে হবে। হিন্দুসমাজ তো বরাবরই নূতন নূতন সম্প্রদায়কে আশ্রয় দিয়েছে, হিন্দুসমাজ সকল ধর্মসম্প্রদায়েরই সমাজ হতে পারে।”

 পরেশবাবু কহিলেন, “মুখের তর্কে একটা জিনিসকে একরকম করে দেখানো যেতে পারে কিন্তু কাজে সেরকমটি পাওয়া যায় না। নইলে কেউ ইচ্ছা করে কি পুরাতন সমাজকে ছাড়তে পারে? যে সমাজ মানুষের ধর্মবোধকে বাহ্য আচারের বেড়ি দিয়ে একই জায়গায় বন্দী করে বসিয়ে রাখতে চায়, তাকে মানতে গেলে নিজেদের চিরদিনের মতো কাঠের পুতুল করে রাখতে হয়।”

 বিনয় কহিল, “হিন্দুসমাজের যদি সেই সংকীর্ণ অবস্থাই হয়ে থাকে তবে সেটা থেকে মুক্তি দেবার ভার আমাদের নিতে হবে; যেখানে ঘরের জানলাদরজা বাড়িয়ে দিলেই ঘরে আলো-বাতাস আসে সেখানে কেউ রাগ করে পাকা বাড়ি ভূমিসাৎ করতে চায় না।”

 ললিতা বলিয়া উঠিল, “বাবা, আমি এ-সমস্ত কথা বুঝতে পারি নে। কোনো সমাজের উন্নতির ভার নেবার জন্যে আমার কোনো সংকল্প নেই। কিন্তু, চারি দিক থেকে এমন একটা অন্যায় আমাকে ঠেলা দিচ্ছে যে আমার প্রাণ যেন হাঁপিয়ে উঠছে। কোনো কারণেই এসমস্ত সহ্য করে মাথা নিচু করে থাকা আমার উচিত নয়। উচিত-অনুচিতও আমি ভালো বুঝি নে— কিন্তু বাবা, আমি পারব না।”

 পরেশবাবু স্নিগ্ধস্বরে কহিলেন, “আরও কিছু সময় নিলে ভালো হয়? এখন তোমার মন চঞ্চল আছে।”

 ললিতা কহিল, “সময় নিতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমি নিশ্চয় জানি, অসত্য কথা ও অন্যায় অত্যাচার বেড়ে উঠতেই থাকবে।

৪৬০