পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঘরে-বাইরে
১৩৩

ওদের দুই-একজনকে ডেকে সেই চিঠিখানা দেখালুম। বি. এ. গম্ভীরভাবে বললে, আমরাও শুনেছি, দেশে একদল লােক মরিয়া হয়ে রয়েছে, স্বদেশীর বাধা দূর করতে তারা না পারে এমন কাজ নেই।

 আমি বললুম, তাদের অন্যায় জবরদস্তিতে দেশের একজন লােকও যদি হার মানে তা হলে সেটাতে সমস্ত দেশের পরাভব।

 ইতিহাসে এম. এ. বললেন, বুঝতে পারছি নে।

 আমি বললুম, আমাদের দেশ দেবতাকে থেকে পেয়াদাকে পর্যন্ত ভয় করে করে আধমরা হয়ে রয়েছে; আজ তােমরা মুক্তির নাম করে সেই জুজুর ভয়কে ফের আর-এক নামে যদি দেশে চালাতে চাও, অত্যাচারের দ্বারা কাপুরুষতাটার উপরে যদি তােমাদের দেশের জয়ধ্বজা রােপণ করতে চাও, তা হলে দেশকে যারা ভালােবাসে তারা সেই ভয়ের শাসনের কাছে এক-চুল মাথা নিচু করবে না।

 ইতিহাসে এম. এ. বললেন, এমন কোন্ দেশ আছে যেখানে রাজ্যশাসন ভয়ের শাসন নয়?

 আমি বললুম, এই ভয়ের শাসনের সীমা কোন পর্যন্ত সেইটের দ্বারাই দেশের মানুষ কতটা স্বাধীন জানা যায়। ভয়ের শাসন যদি চুরি ডাকাতি এবং পরের প্রতি অন্যায়ের উপরেই টানা যায় তা হলে বােঝা যায় যে, প্রত্যেক মানুষকে অন্য মানুষের আক্রমণ থেকে স্বাধীন করবার জন্যেই এই শাসন। কিন্তু মানুষ নিজে কী কাপড় পরবে, কোন দোকান থেকে কিনবে, কী খাবে, কার সঙ্গে বসে খাবে, এও যদি ভয়ের শাসনে বাঁধা হয় তা হলে মানুষের ইচ্ছাকে একেবারে গােড়া ঘেঁষে অস্বীকার করা হয়। সেটাই হল মানুষকে মনুষ্যত্ব থেকে বঞ্চিত করা।

 ইতিহাসে এম. এ. বললেন, অন্য দেশের সমাজেও কি ইচ্ছাকে গােড়া ঘেঁষে কাটবার কোথাও কোনাে ব্যবস্থা নেই?

 আমি বললুম, কে বললে নেই? মানুষকে নিয়ে দাস-ব্যাবসা যে দেশে যে পরিমাণে আছে সে পরিমাণেই মানুষ আপনাকে নষ্ট করছে।

 এম. এ. বললেন, তা হলে ঐ দাস-ব্যাবসাটা মানুষেরই ধর্ম, ওটাই মনুষ্যত্ব।

 বি. এ. বললেন, সন্দীপবাবু এ সম্বন্ধে সেদিন যে দৃষ্টান্ত দিলেন সেটা আমাদের খুব মনে লেগেছে। এই যে ও পারে হরিশ কুণ্ডু আছেন জমিদার, কিংবা সানকিভাঙার চক্রবর্তীরা, ওদের সমস্ত এলেকা ঝাঁট দিয়ে আজ এক ছটাক বিলিতি নুন পাবার জো নেই। কেন? কেননা, বরাবরই ওঁরা জোরের