পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১৫৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৫০
ঘরে-বাইরে

আলাে দেব, আমি জীবন দেব, আমি শক্তি দেব, আমি অমৃত দেব, সেই বিশ্বাসে সেই আনন্দে দুই-কূল ছাপিয়ে আমি বাহির হয়ে পড়েছিলুম। আমার সেই আনন্দকে যদি কেউ পূর্ণ করে তুলত তা হলে আমি মরে গিয়েও বাঁচতুম, আমার সমস্ত সংসার ভাসিয়ে দিয়েও আমার লােকসান হত না।

 আজ কি এরা বলতে চায়, এ-সমস্তই মিথ্যে কথা? আমার মধ্যে যে দেবী আছে ভক্তকে বরাভয় দেবার শক্তি তার নেই? আমি যে স্তবগান শুনেছিলুম, যে গান শুনে স্বর্গ হতে ধুলােয় নেমে এসেছিলুম, সে কি এই ধুলােকে স্বর্গ করবার জন্যে নয়? সে কি স্বর্গকেই মাটি করবার জন্যে?

 সন্দীপ আমার মুখের দিকে তার তীব্র দৃষ্টি রেখে বললে, টাকা চাই রানী।

 অমূল্য আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল— সেই বালক— যে আমার মায়ের গর্ভে জন্মায় নি বটে, কিন্তু সে তাে তার মায়ের গর্ভে জন্মেছিল— সেই মা, সে যে একই মা! আহা, ঐ কচি মুখ, ঐ স্নিগ্ধ চোখ, ঐ তরুণ বয়েস! আমি মেয়েমানুষ, আমি ওর মায়ের জাত, ও আমাকে বললে কিনা ‘আমার হাতে বিষ তুলে দাও’— আর, আমি ওর হাতে বিষই তুলে দেব।

 টাকা চাই রানী!— রাগে লজ্জায় আমার ইচ্ছে হল, সেই সােনার বােঝা সন্দীপের মাথার উপর ছুঁড়ে ফেলে দিই। আমি কিছুতেই আঁচলের গিরে যেন খুলতে পারছিলুম না, থর্‌ থর্‌ করে আমার আঙুলগুলাে কাঁপতে লাগল। তার পর টেবিলের উপর সেই কাগজের মােড়কগুলাে যখন পড়ল তখন সন্দীপের মুখ কালাে হয়ে উঠল। সে নিশ্চয় ভাবলে, ঐ মােড়কগুলাের মধ্যে আধুলি আছে। কী ঘৃণা! অক্ষমতার উপরে কী নিষ্ঠুর অবজ্ঞা! মনে হল, ও যেন আমাকে মারতে পারে। সন্দীপ ভাবলে, আমি বুঝি ওর সঙ্গে দর করতে বসেছি, ওর পাঁচ হাজার টাকার দাবি দু-তিনশাে টাকা দিয়ে রফা করতে চাই। একবার মনে হল, এই মােড়কগুলাে নিয়ে ও জানলার বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। ও কি ভিক্ষুক? ও যে রাজা!

 অমূল্য জিজ্ঞাসা করলে, আর নেই রানীদিদি?

 করুণায় ভরা তার গলা। আমার মনে হল, আমি বুঝি চীৎকার করে কেঁদে উঠব। প্রাণপণে হৃদয়কে চেপে ধরে একটু কেবল ঘাড় নাড়লুম। সন্দীপ চুপ করে রইল; মােড়কগুলাে ছুঁলেও না, একটা কথাও বললে না।

 চলে যাব ভাবছি, কিন্তু কিছুতেই আমার পা চলছে না। পৃথিবী দু-ফাঁক হয়ে আমাকে যদি টেনে নিত তা হলেই এই মাটির পিণ্ড মাটির মধ্যে আশ্রয় পেয়ে বাঁচত।