পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঘরে-বাইরে
১৭১

দেখিয়ে দাও— মানুষকে, মানুষের কর্মক্ষেত্রকে, উনি একবার বড়াে জায়গা থেকে দেখে নিন।

 আমিও ঐ কথাই ভাবছিলুম।

 কিন্তু, আর দেরি কোরাে না। দেখো নিখিল, মানুষের ইতিহাস পৃথিবীর সমস্ত দেশকে সমস্ত জাতকে নিয়ে তৈরি হয়ে উঠেছে। এইজন্যে পলিটিক্সেও ধর্মকে বিকিয়ে দেশকে বাড়িয়ে তােলা চলবে না। আমি জানি, য়ুরােপ এ কথা মনের সঙ্গে মানে না; কিন্তু তাই বলেই যে য়ুরােপই আমাদের গুরু এ আমি মানব না। সত্যের জন্যে মানুষ মরে অমর হয়, কোনাে জাতিও যদি মরে তা হলে মানুষের ইতিহাসে সেও অমর হবে। সেই সত্যের অনুভূতি জগতের মধ্যে এই ভারতবর্ষেই খাঁটি হয়ে উঠুক শয়তানের অভ্রভেদী অট্টহাসির মাঝখানে। কিন্তু বিদেশ থেকে এ কী পাপের মহামারী এসে আমাদের দেশে প্রবেশ করলে!


সমস্ত দিন এই-সব নানা হাঙ্গামে কেটে গেল। শ্রান্ত হয়ে রাত্রে শুতে গেলুম। সেই টাকাটা আজ বের না করে কাল সকালে বের করে নেব স্থির করেছি।

 রাত্রে কখন এক সময় ঘুম ভেঙে গেল। ঘর অন্ধকার। একটা কিসের শব্দ যেন শুনতে পাচ্ছি। বুঝি কেউ কাঁদছে।

 থেকে থেকে বাদলা রাতের দমকা হাওয়ার মতাে চোখের জলে ভরা এক-একটা দীর্ঘনিশ্বাস শুনতে পাচ্ছি। আমার মনে হল আমার এই ঘরটার বুকের ভিতরকার কান্না।

 আমার ঘরে আর-কেউ নেই। বিমলা কিছুদিন থেকে কোনাে-একটা পাশের ঘরে শােয়। আমি বিছানা থেকে উঠে পড়লুম। বাইরের বারান্দায় গিয়ে দেখি, বিমলা মাটির উপর উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে।

 এ-সব কথা লিখতে পারা যায় না। এ যে কী, তা কেবল তিনিই জানেন যিনি বিশ্বের মর্মের মধ্যে বসে জগতের সমস্ত বেদনাকে গ্রহণ করছেন। আকাশ মূক, তারাগুলি নীরব, রাত্রি নিস্তব্ধ— তারই মাঝখানে ঐ একটি নিদ্রাহীন কান্না!

 আমরা এই-সব সুখ-দুঃখকে সংসারের সঙ্গে শাস্ত্রের সঙ্গে মিলিয়ে ভালাে মন্দ একটা-কিছু নাম দিয়ে চুকিয়ে ফেলে দিই। কিন্তু অন্ধকারের বক্ষ ভাসিয়ে দিয়ে এই-যে ব্যথার উৎস উঠছে এর কি কোনাে নাম আছে? সেই নিশীথরাত্রে, সেই লক্ষকোটি তারার নিঃশব্দতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে