পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/৬০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫৬
ঘরে-বাইরে

মশায়দের উৎপাতে এখান থেকে বাস ওঠাতে ইচ্ছে করে। নিখিলেশের মতাে মানুষ মৃত্যুকাল পর্যন্ত এই সংসারটাকে ইস্কুল বানিয়ে রেখে দিতে চায়। বয়স হল, তবু ইস্কুল পিছন পিছন চলল। সংসারে প্রবেশ করলে, সেখানেও ইস্কুল এসে ঢুকল। উচিত, মরবার সময়ে ইস্কুল-মাস্টারটিকে সহমরণে টেনে নিয়ে যাওয়া। সেদিন আমাদের আলাপের মাঝখানে অসময়ে সেই মূর্তিমান ইস্কুল এসে হাজির। আমাদের সকলেরই ধাতের মধ্যে এক জায়গায় একটা ছাত্র বাসা করে আছে বােধ করি। আমি যে এ-হেন দুর্‌বৃত্ত আমিও কেমন থমকে গেলুম। আর, আমাদের মক্ষী— তার মুখ দেখেই মনে হল সে এক মুহূর্তেই ক্লাসের সব চেয়ে ভালাে ছাত্রী হয়ে একেবারে প্রথম সারে গম্ভীর হয়ে বসে গেল; তার হঠাৎ যেন মনে পড়ে গেল পৃথিবীতে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার একটা দায় আছে। এক-একটা মানুষ রেলের পয়েণ্টসম্যানের মতাে পথের ধারে বসে থাকে, তারা ভাবনার গাড়িকে খামকা এক লাইন থেকে আর-এক লাইনে চালান করে দেয়।

 চন্দ্রনাথবাবু ঘরে ঢুকেই সংকুচিত হয়ে ফিরে যাবার চেষ্টা করছিলেন। ‘মাপ করবেন— আমি’— কথাটা শেষ করতে না-করতেই মক্ষী তাঁর পায়ের কাছে নত হয়ে প্রণাম করলে আর বললে, মাস্টারমশায়, যাবেন না, আপনি বসুন। সে যেন ডুব-জলে পড়ে গেছে, মাস্টারমশায়ের আশ্রয় চায়। ভীরু! কিংবা আমি হয়তাে ভুল বুঝছি। এর ভিতরে হয়তাে একটা ছলনা আছে। নিজের দাম বাড়াবার ইচ্ছা। মক্ষী হয়তাে আমাকে আড়ম্বর করে জানাতে চায় যে, তুমি ভাবছ তুমি আমাকে অভিভূত করে দিয়েছ। কিন্তু তােমার চেয়ে চন্দ্রনাথবাবুকে আমি ঢের বেশি শ্রদ্ধা করি। তাই করােনা। মাস্টারমশায়দের তাে শ্রদ্ধা করতেই হবে। আমি তাে মাস্টারমশায় নই। আমি ফাঁকা শ্রদ্ধা চাই নে। আমি তাে বলেইছি ফাঁকিতে আমার পেট ভরবে না; আমি বস্তু চিনি।

 চন্দ্রনাথবাবু স্বদেশীর কথা তুললেন। আমার ইচ্ছে ছিল তাঁকে একটানা বকে যেতে দেব, কোনাে জবাব করব না। বুড়াে মানুষকে কথা কইতে দেওয়া ভালাে। তাতে তাদের মনে হয়, তারাই বুঝি সংসারের কলে দম দিচ্ছে; বেচারারা জানতে পারে না তাদের রসনা যেখানে চলছে সংসার তার থেকে অনেক দূরে চলছে। প্রথমে খানিকটা চুপ করেই ছিলুম— কিন্তু সন্দীপচন্দ্রের ধৈর্য আছে এ বদনাম তার পরম শত্রুরাও দিতে পারবে না।

 চন্দ্রনাথবাবু যখন বললেন, দেখুন, আমরা কোনােদিনই চাষ করি নি, আজ এখনই হাতে হাতে ফসল পাব এমন আশা যদি করি তবে—