পাতা:চরিত্রহীন - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চরিত্রহীন Sb9 জ্যাঠামশা যে পাকা রাসােতাটা বরাবর সাঁওতাল পরগনার ভিতর দিয়া বৈদ্যানাথ হইতে দমকায় গিয়াছে, তাহারই ধারে বাগানের মধ্যে বৈদ্যনাথ হইতে প্রায় ক্লোশ-দই দরে একটা বাঙলো ছিল । কলিকাতা হইতে চলিয়া আসিয়া সতীশ খোঁজ করিয়া এই বাড়িটা ভাড়া লইয়া বাস করিতেছিল । নিজের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করিয়া লইবার জন্যই সে এই নিরালায় অজ্ঞাতবাস করিতে আসিয়াছিল। সতরাং যখন দেখিতে পাইল, ইহার আশেপাশে গ্রাম নাই, সমমাখের রাস্তাটায় লোক-চলাচলও নিতান্ত বিরল, তখন খশী হইয়াই বলিয়াছিল, “এই আমার চাই। এমনি নিজৰ্শন নীরবতাই আমার প্রয়োজন।” কলিকাতা হইতে সে যে অপযশ ও দঃখের বোঝা বহিয়া আনিয়াছিল, বিরলে বসিয়া একটা একটা করিয়া এইগলারই হিসাব-নিকাশ করা তাহার মনোগত অভিপ্রায় । প্রথম দফায় সাবিত্রীকে তাহার যারপরনাই ঘণা করা প্রয়োজন, দ্বিতীয় দফায় পাথরেঘাটার বৌঠাকরানকে ভোলা চায় এবং তৃতীয় দফায় উপদ্বীনদার সহিত সমস্ত সক্ষবন্ধ বিচ্ছিন্ন করিয়া ফেলিতেই হইবে । এই সমস্ত কঠিন কাজ এই বনের মধ্যে বসিয়া শোধ করাই তাহার উদ্দেশ্য । সঙ্গে ছিল বেহারী এবং একজন এদেশী পাচক-ব্রিাহ্মণ । বেহারীর কাজ ছিল বাবার সেবা করিয়া অবশিষ্ট সময়টুক পাচকের সহিত বাদােনাবাদ করিয়া তাহাকে মাখ এবং আনাড়ী প্রতিপন্ন করা, আর অন্যের কাজ ছিল ভাত ডাল সিদ্ধ করিয়া বাকী সময়টুকু বেহারীর সহিত কলহ করিয়া সে যে বাজারের পয়সা দই হাতে চরি করিতেছে। ইহাই সাব্যস্ত করা । অতএব এ-পক্ষের দিনগলা ত এক রকম কাটিতে লাগিল, কিন্তু প্ৰভু যিনি, তিনি অন্যািক্ষণ কেবল তত্ত্ব-চিন্তাতেই মগ্ন রহিলেন । সংসারে কামিনী-কাঞ্চনাই যে সকল অনাথের মািল, বৈরাগ্যই যে পরম বস্তু, পাখির ডাকই যে চরম সঙ্গীত, বন-জঙ্গল পাহাড়-পর্বতই যে সৌন্দয্যের নিখত আদশ, এই সত্য সম্পণে হৃদয়ঙ্গম করাই তাহার সম্প্রতি সাধনার বস্তু। সতরাং, বারান্দার উপর একখানা ভাঙ্গা আরামকেদাৱায় সতীশ সারাদিন গাছের ডাল পাখির কিচিমিচি কান খাড়া করিয়া শনিতে লাগিল, মহীয়া বক্ষে বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দ কোন রাগ-রাগিণীতে পাণ, চিন্তা করিতে লাগিল, আকাশে যা-তা মেঘ দেখিয়া উচ্ছসিত হইয়া মনে মনে প্রশংসা করিতে লাগিল এবং দরে পাহাড়ের গায়ে শতক বাঁশি-পাতায় আগান ধরিলে সারারান্ত্রি জাগিয়া চাহিয়া রহিল । এদিকে মাছ-মাংস ছাড়িয়া দিয়া সাত্ত্বিক আহার ধরিল এবং কোথা হইতে একটা সাদা পাথরনড়ি কড়াইয়া আনিয়া দিনের বেলা পজা এবং রাত্রে আরতি করিতে শর করিয়া ছিল । অথচ, এই নব-প্ৰণালীর জীবনযাত্রার সহিত তাহার কোনকালেই পরিচয় ছিল না। ইতিপবে চিরকাল তাহার কাছে পাখির শব্দের চেয়ে সেতারের শব্দই মিন্ট লাগিয়াছে, বাতাসের মধ্যে রাগ-রাগিণীর অস্তিত্ব কখনো সে সবপ্নেও কল্পনা করে নাই এবং আকাশের গায়ে মেঘ্যোদয় কোনদিনই তাহাকে বিচলিত করে গাই ৷