পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
১১৯

মতাে করিয়া তুলিতে চায়। তাহা সত্য হইবে, অথচ অল্প হইবে— তাহাতে সংসারের কোনাে বিধিবিধান, কোনাে দায়িত্ব, কোনাে বাস্তবিকতা থাকিবে না।

 আজ সকাল হইতে মহেন্দ্র চঞ্চল হইয়া বেড়াইতে লাগিল, কলেজে যাইতে পারিল না; কারণ মিলনের লগ্নটি কখন অকস্মাৎ আবির্ভূত হইবে, তাহা তাে কোনাে পঞ্জিকায় লেখে না।

 গৃহকার্যে-রত বিনােদিনীর কণ্ঠস্বর মাঝে মাঝে ভাঁড়ার হইতে, রান্নাঘর হইতে, মহেন্দ্রের কানে আসিয়া পৌঁছিতে লাগিল। আজ তাহা মহেন্দ্রের ভালাে লাগিল না; আজ বিনােদিনীকে মনে মনে সংসার হইতে বহু দূরে স্থাপন করিয়াছে।

 সময় কাটিতে চায় না। মহেন্দ্রের স্নানাহার হইয়া গেল, সমস্ত গৃহকর্মের বিরামে মধ্যাহ্ন নিস্তব্ধ হইয়া আসিল, তবু বিনোদিনীর দেখা নাই। দুঃখে এবং সুখে, অধৈর্যে এবং আশায় মহেন্দ্রের মনোযন্ত্রের সমস্ত তারগুলা ঝংকৃত হইতে লাগিল।

 কালিকার কাড়াকাড়ি-করা সেই বিষবৃক্ষখানি নীচের বিছানায় পড়িয়া আছে। দেখিব মাত্র সেই কাড়াকাড়ির স্মৃতিতে মহেন্দ্রের মনে পুলকাবেশ জাগিয়া উঠিল। বিনোদিনী যে বালিশ চাপিয়া শুইয়াছিল সেই বালিশটা টানিয়া লইয়া মহেন্দ্র তাহাতে মাথা রাখিল; এবং বিষবৃক্ষখানি তুলিয়া লইয়া তাহার পাতা উল্টাইতে লাগিল। ক্রমে কখন এক সময় পড়ায় মন লাগিয়া গেল, কখন পাঁচটা বাজিয়া গেল— হুঁশ হইল না।

 এমন সময় একটি মােরাদাবাদি খুঞ্চের উপর থালায় ফল ও সন্দেশ এবং রেকাবে বরফ-চিনি সংযুক্ত সুগন্ধি দলিত খরমুজা লইয়া বিনােদিনী ঘরে প্রবেশ করিল এবং মহেন্দ্রের সম্মুখে রাখিয়া কহিল, “কী করিতেছ, ঠাকুরপাে। তােমার হইল কী। পাঁচটা বাজিয়া গেছে, এখনাে তােমার হাতমুখ-ধােওয়া কাপড়-ছাড়া হইল না?”

 মহেন্দ্রের মনে একটা ধাক্কা লাগিল। মহেন্দ্রের কী হইয়াছে, সে কি জিজ্ঞাসা করিবার বিষয়। বিনােদিনীর সে কি অগোচর থাকা উচিত। আজিকার দিন কি অন্য দিনেরই মতাে। পাছে যাহা আশা করিয়াছিল, হঠাৎ তাহার উল্টা কিছু দেখিতে পায়, এই ভয়ে মহেন্দ্র গতকল্যকার কথা স্মরণ করাইয়া কোনাে দাবি উত্থাপন করিতে পারিল না।

 মহেন্দ্র খাইতে বসিল। বিনােদিনী ছাদে-বিছানো রৌদ্রে-দেওয়া মহেন্দ্রের কাপড়গুলি দ্রুতপদে ঘরে বহিয়া আনিয়া নিপুণ হস্তে ভাঁজ করিয়া কাপড়ের আলমারির মধ্যে তুলিতে লাগিল।