পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৭০
চোখের বালি

দিয়া কহিল, “তোমার দুধ ও ফল আনিয়াছি, খাবে এসো।”

 করুণমূর্তি বধূর এই অনভ্যস্ত সেবার চেষ্টা দেখিয়া রাজলক্ষ্মীর শুক চক্ষু প্লাবিত হইয়া গেল। তিনি উঠিয়া বসিয়া আশাকে কোলে লইয়া তাহার অশ্রুজলসিক্ত কপোল চুম্বন করিলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহিন এখন কী করিতেছে বউমা।”

 আশা অত্যন্ত লজ্জিত হইল; মৃদুস্বরে কহিল, “তিনি চলিয়া গেছেন।

 রাজলক্ষ্মী। কখন চলিয়া গেল, আমি তো জানিতেও পারি নাই।

 আশা নতশিরে কহিল, “তিনি কাল রাত্রেই গেছেন।”

 শুনিবা মাত্র রাজলক্ষ্মীর সমস্ত কোমলতা যেন দূর হইয়া গেল; বধুর প্রতি তাঁহার আদরস্পর্শের মধ্যে আর রসলেশমাত্র রহিল না, আশা একটা নীরব লাঞ্ছনা অনুভব করিয়া নতমুখে আস্তে আস্তে চলিয়া গেল।


৪১

প্রথম রাত্রে বিনোদিনীকে পটলডাঙার বাসায় রাখিয়া মহেন্দ্র যখন তাহার কাপড় ও বই আনিতে বাড়ি গেল, বিনোদিনী তখন কলিকাতার বিশ্রামবিহীন জনতরঙ্গের কোলাহলে একলা বসিয়া নিজের কথা ভাবিতেছিল। পৃথিবীতে তাহার আশ্রয়স্থান কোনো কালেই যথেষ্ট বিস্তীর্ণ ছিল না, তবু তাহার এক পাশ তাতিয়া উঠিলে আর-এক পাশে ফিরাইয়া শুইবার একটুখানি জায়গা ছিল― আজ তাহার নির্ভরস্থল অত্যন্ত সংকীর্ণ। সে যে-নৌকায় চড়িয়া স্রোতে ভাসিয়াছে তাহার দক্ষিণে বামে একটু কাত হইলেই একেবারে জলের মধ্যে গিয়া পড়িতে হইবে। অতএব বড়োই স্থির হইয়া হাল ধরা চাই, একটু ভুল একটু নাড়াচাড়া সহিবে না। এ অবস্থায় কোন্ রমণীর হৃদয় না কম্পিত হয়। পরের মন সম্পূর্ণ বশে রাখিতে যেটুকু লীলা খেলা চাই, যেটুকু অন্তরালের প্রয়োজন, এই সংকীর্ণতার মধ্যে তাহার অবকাশ কোথায়। একেবারে মহেন্দ্রের সহিত মুখোমুখি করিয়া তাহাকে সমস্ত জীবন যাপন করিতে প্রস্তুত হইতে হইবে। প্রভেদ এই যে, মহেন্দ্রের কূলে উঠিবার উপায় আছে, কিন্তু বিনোদিনীর তাহা নাই।

 বিননাদিনী নিজের এই অসহায় অবস্থা যতই সুস্পষ্ট বুঝিল ততই সে মনের মধ্যে বল সঞ্চয় করিতে লাগিল। একটা উপায় করিতেই হইবে, এভাবে তাহার চলিবে না।

 যেদিন বিহারীর কাছে বিনোদিনী নিজের প্রেম নিবেদন করিয়াছে, সেদিন হইতে তাহার ধৈর্যের বাধ ভাঙিয়া গেছে। যে উদ্যত চুম্বন বিহারীর মুখের কাছ