অন্নপূর্ণা কহিলেন, “একবার বিহারীর বাড়িতে গিয়া তাহার সংবাদ জানিয়া আইস।”
সাধুচরণ ফিরিয়া আসিয়া কহিলেন, “তিনি বাড়িতে নাই, বালিতে গঙ্গার ধারে বাগানে গিয়াছেন।”
অন্নপূর্ণা নবীন-ডাক্তারকে ডাকিয়া রোগীর অবস্থা জিজ্ঞাসা করিলেন। ডাক্তার কহিল, “হৃৎপিণ্ডের দুর্বলতার সঙ্গে উদরী দেখা দিয়াছে, মৃত্যু অকস্মাৎ কখন আসিবে কিছুই বলা যায় না।”
সন্ধ্যার সময় রাজলক্ষ্মীর রোগের কষ্ট যখন বাড়িয়া উঠিতে লাগিল, তখন অন্নপূর্ণা জিজ্ঞাসা করিলেন, “দিদি, একবার নবীন-ডাক্তারকে ডাকাই?”
রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “না মেজবউ, নবীন-ডাক্তার আমার কিছুই করিতে পারিবে না।”
অন্নপূর্ণা কহিলেন, “তবে কাহাকে তুমি ডাকিতে চাও, বলো।”
রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “একবার বিহারীকে যদি খবর দাও তো ভালো হয়।”
অন্নপূর্ণার বক্ষের মধ্যে আঘাত লাগিল। সেদিন দূর প্রবাসে সন্ধ্যাবেলায় তিনি দ্বারের বাহির হইতে অন্ধকারের মধ্যে বিহারীকে অপমানের সহিত বিদায় করিয়া দিয়াছিলেন, সেই বেদনা তিনি আজ পর্যন্ত ভুলিতে পারেন নাই। বিহারী আর কখনোই তাঁহার দ্বারে ফিরিয়া আসিবে না। ইহজীবনে আর যে কখনো সেই অনাদরের প্রতিকার করিতে অবসর পাইবেন, এ আশা তাঁহার মনে ছিল না।
অন্নপূর্ণা একবার ছাদের উপর মহেন্দ্রের ঘরে গেলেন। বাড়ির মধ্যে এই ঘরটিই ছিল আনন্দনিকেতন। আজ সে ঘরের কোনো শ্রী নাই― বিছানাপত্র বিশৃঙ্খল, সাজসজ্জা অনাদৃত, ছাদের টবে কেহ জল দেয় না, গাছগুলি শুকাইয়া গেছে।
মাসিমা ছাদে গিয়াছেন বুঝিয়া আশাও ধীরে ধীরে তাঁহার অনুসরণ করিল। অন্নপূর্ণা তাহাকে বক্ষে টানিয়া লইয়া তাহার মস্তক চুম্বন করিলেন। আশা নত হইয়া দুই হাতে তাঁহার দুই পা ধরিয়া বারবার তাঁহার পায়ে মাথা ঠেকাইল। কহিল, “মাসিমা, আমাকে আশীর্বাদ করো, আমাকে বল দাও। মানুষ যে এত কষ্ট সহ্য করিতে পারে, তাহা আমি কোনো কালে ভাবিতেও পারিতাম না। মা গো, এমন আর কত দিন সহিবে।”
অন্নপূর্ণা সেইখানেই মাটিতে বসিলেন, আশা তাঁহার পায়ে মাথা দিয়া লুটাইয়া পড়িল। অন্নপূর্ণা আশার মাথা কোলের উপর তুলিয়া লইলেন, এবং কোনো কথা