বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৬
চোখের বালি

পড়া হইতেছে না, আজ হইতে আমি নীচে মাসিমার ঘরে গিয়া থাকিব।”

 এ বয়সে এতবড়ো কঠিন সন্ন্যাসব্রত! শয়নালয় হইতে একেবারে মাসিমার ঘরে আত্মনির্বাসন! এই কঠোর প্রতিজ্ঞা উচ্চারণ করিতে তাহার চোখের প্রান্তে জল আসিয়া পড়িল, তাহার অবাধ ক্ষুদ্র অধর কাঁপিয়া উঠিল এবং কণ্ঠস্বর রুদ্ধপ্রায় হইয়া আসিল।

 মহেন্দ্র কহিল, “তবে তাই চলো, কাকীর ঘরেই যাওয়া যাক— কিন্তু তাহা হইলে তাঁহাকে উপরে আমাদের ঘরে আসিতে হইবে।”

 আশা এতবড়ো উদার গম্ভীর প্রস্তাবে পরিহাস প্রাপ্ত হইয়া রাগ করিল। মহেন্দ্র কহিল, “তার চেয়ে তুমি স্বয়ং দিনরাত্রি আমাকে চোখে চোখে রাখিয়া পাহারা দাও, দেখো আমি এক্জামিনের পড়া মুখস্থ করি কি না।”

 অতি সহজেই সেই কথা স্থির হইল। চোখে চোখে পাহারার কার্য কিরূপ ভাবে নির্বাহ হইত, তাহার বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া অনাবশ্যক; কেবল এইটুকু বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, সে বৎসর মহেন্দ্র পরীক্ষায় ফেল করিল এবং চারুপাঠের বিস্তারিত বর্ণনা সত্ত্বেও পুরুভূজ সম্বন্ধে আশার অনভিজ্ঞতা দূর হইল না।

 এইরূপ অপূর্ব পঠনপাঠন-ব্যাপার যে সম্পূর্ণ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হইয়াছিল, তাহা বলিতে পারি না। বিহারী মাঝে মাঝে আসিয়া অত্যন্ত গোল বাধাইয়া দিত। “মহিনদা মহিনদা” করিয়া সে পাড়া মাথায় করিয়া তুলিত। মহেন্দ্রকে তাহার শয়নগৃহের বিবর হইতে টানিয়া না বাহির করিয়া সে কোনোমতেই ছাড়িত না। পড়ায় শৈথিল্য করিতেছে বলিয়া সে মহেন্দ্রকে বিস্তর ভর্ৎসনা করিত। আশাকে বলিত, “বউঠান, গিলিয়া খাইলে হজম হয় না, চিবাইয়া খাইতে হয়; এখন সমস্ত অন্ন এক গ্রাসে গিলিতেছ, ইহার পরে হজমিগুলি খুঁজিয়া পাইবে না।”

 মহেন্দ্র বলিত, “চুনি, ও কথা শুনিয়ো না— বিহারী আমাদের মুখে হিংসা করিতেছে।”

 বিহারী বলিত, “সুখ যখন তোমার হাতেই আছে, তখন এমন করিয়া ভোগ করো যাহাতে পরের হিংসা না হয়।”

 মহেন্দ্র উত্তর করিত, “পরের হিংসা পাইতে যে সুখ আছে। চুনি, আর-একটু হইলেই আমি গর্দভের মতো তোমাকে বিহারীর হাতে সমর্পণ করিতেছিলাম!”

 বিহার রক্তবর্ণ হইয়া বলিয়া উঠিত, “চুপ!”

 এই-সকল ব্যাপারে আশা মনে মনে বিহারীর উপরে ভারি বিরক্ত হইত। একসময় তাহার সহিত বিহারীর বিবাহ প্রস্তাব হইয়াছিল বলিয়াই বিহারীর প্রতি