পাতা:ছন্দ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৮৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৫৮
ছন্দ

মাত্রা মিলিয়ে এই ছন্দ বাংলায় লেখা যাক।

বৃষ্টিধারা শ্রাবণে ঝরে গগনে,
শীতল পবন বহে সঘনে,
কনক-বিজুরি নাচে রে, অশনি গর্জন করে।
নিষ্ঠুর-অন্তর মম প্রিয়তম নাই ঘরে।[১]

বাঙালি পাঠকের কান একে রীতিমতো ছন্দ বলে মানতে বাধা পাবে তাতে সন্দেহ নেই, কারণ এর পদবিভাগ প্রায় গদ্যের মতোই অসমান। যাই হোক, এর মধ্যে একটা ছন্দের কাঠামো আছে; সেটুকুও যদি ভেঙে দেওয়া যায় তাহলে কাব্যকেই কি ভেঙে দেওয়া হল। দেখা যাক।

অবিরল ঝরছে শ্রাবণের ধারা,
বনে বনে সজল হাওয়া বয়ে চলেছে,
সোনার বরন ঝলক দিয়ে নেচে উঠছে বিদ্যুৎ,
বজ্র উঠছে গর্জন করে।
নিষ্ঠুর আমার প্রিয়তম ঘরে এল না।

একে বলতে হবে কাব্য, বুদ্ধির সঙ্গে এর বোঝাপড়া নয়, একে অনুভব করতে হয় রসবোধে। সেইজন্যেই যতই সামান্য হোক, এর মধ্যে বাক্যসংস্থানের একটা শিল্পকলা শব্দব্যবহারের একটা ‘তেরছ চাহনি’ রাখতে হয়েছে। সুবিহিত গৃহিণীপনার মধ্যে লোকে দেখতে পায় লক্ষ্মীশ্রী, বহু উপকরণে বহু অলংকারে তার প্রকাশ নয়। ভাষার কক্ষেও অনতিভূষিত গৃহস্থালি গদ্য হলেও তাকে সম্পূর্ণ গদ্য বলা চলবে না, যেমন চলবে না আপিসঘরের অসজ্জাকে অন্তঃপুরের সরল শোভনতার সঙ্গে তুলনা করা। আপিসঘরে ছন্দটা প্রত্যক্ষই বর্জিত, অন্যত্র ছন্দটা নিগূঢ় মর্মগত, বাহ্য ভাষায় নয়, অন্তরের ভাবে।

  1. এই তরজমাটিতে মালা ছন্দের ধ্বনি ও মাত্রাবিন্যাস স্থলে-স্থলে লঙ্ঘিত হয়েছে। ‘বৃষ্টি’ শব্দে লঘুত্বের বিধান রক্ষিত হয়নি এবং দীর্ঘস্বরগুলিকে সর্বত্রই লঘু বলে ধরা হয়েছে। তাছাড়া ‘ণিঅলং’ শব্দটিকে গণনা করা হয়নি বলে দ্বিতীয় পদে আরও চার মাত্রা কম পড়েছে। টীকাকারদের মতে ‘ফুল্লিজা ণীবা’ কথার অর্থ ‘পুষ্পিতা নীপাঃ’। উপরের তরজমায় এই অর্থ গৃহীত হয়নি।