পাতা:ছিন্নপত্র-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৭৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

( لا ما ) থেকে স্বামীর ঘরে যাচ্চে । নোকে যখন ছেড়ে দিলে মেয়েরা ডাঙায় দাড়িয়ে চেয়ে রইল, দুই একজন আঁচল দিয়ে ধীরে ধীরে নাক্চোথ মুছতে লাগল। একটি ছোট মেয়ে, খুব এটে চুল বাধা, একটি বর্ষীয়সীর কোলে চড়ে তার গল। জড়িয়ে তার কাধের উপর মাথাটি রেখে নিঃশব্দে কঁদিতে লাগল । যে গেল সে বোধ হয় এ বেচারির দিদিমণি, এর পুতুলখেলায় বোধ হয় মাঝেমাঝে যোগ দিত, বোধ হয় দুষ্টুমি করলে মাঝেমাঝে সে একে ঢিপিয়ে দিত । সকালবেলাকার রৌদ্র এবং নদীতীর এবং সমস্ত এমন গভীর বিষাদে পূর্ণ বোধ হতে লাগল ! সকালবেলাকার একটা অত্যন্ত হতাশ্বাস করুণ রাগিণীর মত । মনে হল সমস্ত পৃথিবীটা এমন সুন্দর অথচ এমন বেদনায় পরিপূর্ণ ! এই অজ্ঞাত ছোট মেয়েটির ইতিহাস আমার যেন অনেকটা পরিচিত হয়েগেল । বিদায়কালে এই নোকে করে নদীর স্রোতে ভেসেযাওয়ার মধ্যে যেন আরো একটু বেশি করুণা আছে । অনেকটা যেন মৃত্যুর মত—তীরথেকে প্রবাহে ভেসে যাওয়া—যারা দাড়িয়ে থাকে তার। আবার চোখ মুছে ফিরেযায়, যে ভেসেগেল সে অদৃশ্য হয়েগেল । জানি, এই গভীর বেদনাটুকু, যারা রইল এবং যে গেল উভয়েই ভুলে যাবে, হয়ত এতক্ষণে অনেকটা লুপ্তহয়ে গিয়েছে । বেদনাটুকু ক্ষণিক এবং বিস্মৃতিই চিরস্থায়ী কিন্তু ভেবে দেখতে গেলে এই বেদনাটুকুই বাস্তবিক সত্য—বিস্মৃতি সত্যি নয় । একএকটা বিচ্ছেদ এবং একএকটা মৃত্যুর সময় মানুষ সহসা জানতে পারে এই ব্যথাটা কি ভয়ঙ্কর সত্য । জানতে পারে, যে মানুষ কেবল ভ্রমক্রমেই নিশ্চিন্ত থাকে । কেউ থাকে না—এবং সেইটে মনে করলে মানুষ আরো ব্যাকুল হয়ে ওঠে । কেবল যে থাকবন তা নয়, কারো মনেও থাকব না । একেবারে আমাদের দেশের করুণ রাগিণী ছাড়া সমস্ত মানুষের পক্ষে আর কোন গান সম্ভবে না ।