পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী
৩৭

 বিধান আসিলে বলে, ভাইকে কোলে নিয়ে বােসো তাে বাবা, বুকুকে শুইয়ে দিয়ে আসি।

 বিধানের হাতে খড়ি হইয়া গিয়াছে, এখন সে প্রথমভাগের পাঠক। ছেলেবেলা হইতে লিভার খারাপ হইয়া শরীরটা তাহার শীর্ণ হইয়া গিয়াছে, মাঝে মাঝে অসুখে ভােগে। মুখখানি অপরিপুষ্ট ফুলের মত কোমল। শরীর ভাল না হােক ছেলেটার মাথা হইয়াছে খুব সাফ। বুলি ফুটিবাব পর হইতেই প্রশ্নে প্রশ্নে সকলকে সে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিয়াছে, জগতের দিকে চোখ মেলিয়া চাহিয়া তাহার শিশু-চিত্তে যে সহস্র প্রশ্নের সৃষ্টি হয় প্রত্যেকটির জবাব পাওযা চই। মনোজগতে সে দুর্জ্ঞেয় রহস্য থাকিতে দিবে না—তাহার জিজ্ঞাসার এই সীমা নাই। সবজান্তা হইবার জন্য তাহার এই ব্যাকুল প্রয়াসে সবজান্তারা কখনাে হাসে কখনাে বিরক্ত হয়। বিবক্ত বেশি হয় শীতল। বিধানের গােটা দশেক কেনর জবাব দিয়া পরবর্তী পুনরাবৃত্তিতে সে ধমক লাগায়। শ্যামাব ধৈর্য অনেকক্ষণ বজায় থাকে। অনেক সময় হাতের কাজ করিতে করিতে যা মনে আসে জবাব দিয়া যায়, সব সময় খেয়ালও থাকে না কি বলিতেছে। বিধানেব চিন্তাজগত মিথ্যায় ভরিয়া ওঠে মনে তাহার বহু অসত্যের ছাপ লাগে।

 দিনের মধ্যে এমন কতগুলি প্রহর আছে শ্যামাকে যখন যাচিয়া ছেলেব মুখে মুখরতা আনিতে হয়। বিধান মাঝে মাঝে গম্ভীর হইয়া থাকে। গভীব অন্যমনস্কতায় ডুবিয়া গিয়া সে স্থির হইয়া বসিয়া থাকে, চোখ দুটি উদাসীন হইয়া যায়। স্প্রিংএর মােটরটি পাশে পডিয়া থাকে, ছবির বইটির পাতা বাতাসে উল্টাইয়া যায়, সে চাহিয়া দেখে না। ছেলের মুখ দেখিয়া শ্যামার বুকের মধ্যে কেমন করিয়া ওঠে। যেন ঘুমন্ত ছেলেকে ডাকিয়া তুলিতেছে এমনিভাবে সে ডাকে, খােকা, এই খােকা!

 উঁ?

 আয় তাে আমার কাছে। দ্যাখ তোর জন্যে কেমন জামা করছি।

 বিধান কাছেও আসে, জামাও দ্যাখে কিন্তু তাহার কোন রকম উৎসাহ দেখা যায় না।

 শ্যামা উদ্বিগ্ন হইয়া বলে, কি ভাবছিস রে তুই? কার কথা ভাবছিস?