পাতা:জীবনানন্দ সমগ্র (তৃতীয় খণ্ড).pdf/১১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নেই। কুকুরটাও ঢের বুড়ো হয়ে গিয়েছে বোধ করি— বেঁচে আছে তো? কমলা এ সব প্রশ্নের কোনো উত্তরই দেয় না। কুকুর-বিড়ালকে সে জীবনের গ্রাহ্য জিনিশের মধ্যেই ধরে না। কেতুর যখন দু-তিন মাস বয়স মোটে, সারা রাত এমন চিৎকার করে অস্থির করত মানুষকে—প্রভাত এক দিন রাগ করে বারান্দার থেকে বাচ্চাটাকে উঠানে ছুড়ে মেরেছিল। মরে নি; কিন্তু একটা পা ভেঙে গেল। কত রকম ফিকির, চেষ্টা, কিন্তু সে পা আর জোড়া লাগল না। কুকুরটি বড় হয়েও খুঁড়য়ে খুঁড়িয়ে হাটে—চার বছর আগে দেখে এসেছিল প্রভাত—কুকুরটার বেশ স্ফূর্তি-আনন্দ-জীবনোচ্ছাস কিন্তু উর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে গিয়ে ল্যাং ল্যাং করে—একটা অপ্রীতিকর বাধা সব সময়ই বহন করতে হয় বেচারিকে— قي বাড়ি গিয়ে কুকুরটাকে এবার মাছের কাটা দুধ-ভাত নিয়মিত দেবে সে; খোড়া পায়েরও একটা ব্যবস্থা করা যায় নাকি? দেখবে সে। বাস্তবিক, কেতু যেন মাঝেমাঝে এ মেসের কামরার ভিতর থেকেও প্রভাতকে টানে—কী যেন বোবার কথা জানাতে আসে; হয়তো উচ্ছিষ্টমাখা ভাত আজকাল আর জুটছে না তেমন, হয়তো তিন-চারদিন না খেয়েই থাকতে হয়, হয়তো খিদের লোভে মড়া বিড়ালের মাংস খায়, শকুনদের ভাগাড়ের চারদিকে ঘোরাঘুরি করে, গোরুর ঠ্যাং কুড়িয়ে আনে, বাঁশের জঙ্গলের ছায়ায় বসে সমস্তটা দুপুর চিবোয় তাই—তারপর বিকেলের ছায়া নিস্তব্ধ হয়ে নেমে আসে যখন, তখন বঁাশ ও কাঠালের জঙ্গলের কিনারে বসে অবাক হয়ে প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে থাকে হয়তো—ঘণ্টার পর ঘণ্টা আশ্চর্য হয়ে ভাবে : কোথায় সে গেল ? এই চার বছর ধরেই তাকে খুঁজছি, তবুও দেখা পাই নে কেন ? কোথায় ? ধীরে-ধীরে চোখ বোজে হয়তো কেতু, ঘুমায় না; মাটির ওপর শুয়ে জিভ বের করে ভাবতে থাকে হয়তো এতদিন মানুষের কাছ থেকে সে যত অকল্যাণ ও গ্লানি পেল প্রভাত এলে সমস্ত জানাবে তাকে সে— ভোমরা গুন গুন করে মরে; সজনে গাছের শাদা ফুলগুলো বাতাসে উড়তে থাকে, শুকনো বন চালতা ও কদমের পাতা ঝরে পড়ে, জঙ্গলের থেকে গোটা দুই বেজি ঝাড়া দিয়ে তার ব্যথিত বিচ্ছিন্ন নিদ্রার থেকে উঠে বসে—বিহ্বল হয়ে চারিদিকে তাকায়—সন্দিগ্ধ হয়ে ভাবে এ গায়ে সে আর নেই; কিন্তু এ চার বছরের ভিতর আশেপাশের কত গা খুঁজে এসেছে সে—সে মানুষকে সে কোথাও তো পেল না; খানিকটা দূরে একটা শুকনো কচ্ছপের চাড়া পড়ে আছে—শ্রদ্ধাহীন ভাবে সেটার দিকে তাকায় বোধ করি কুকুরটা। একবার হাই তোলে, ভোমরার গুনগুনানি কানে ভেসে আসে; হলদে প্রজাপতিটার অক্লান্ত ওড়াউড়ির দিকে অবসাদ ভরে তাকিয়ে দেখে; তারপর খামোক লাফিয়ে উঠে শুকনো পাতার উপর দিয়ে খামচ-খামচ করে হেঁটে মস্তবড় যজ্ঞডুমুরের গাছটার পিছনে প্রান্তরের দিকে অন্তহিত হয়ে যায়— কেতুর কথা ভাবতে গিয়ে চুরুটে আর টান দেয় নি প্রভাত; চুরুটটা নিভে গেছে। সেই নিরঞ্জন ধোপার দিন কাটছে কেমন? সেই চার বছর আগে দেখা। পাটের দর কমে গেছে বলে সে তো বড্ড ক্ষুব্ধ হয়ে গিয়েছিল; পাটের চাষ সে অল্পসল্প করত বটে—কিন্তু তা এত তুচ্ছ অকিঞ্চিৎকর যে অতখানি ক্ষুব্ধ হবার কোনো > > 。