পাতা:জীবনানন্দ সমগ্র (তৃতীয় খণ্ড).pdf/১৪১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

থাকতাম। আট-দশ রকমের সুটও ছিল আমার। দিনের মধ্যেই তিন-চারবার করে বদলাতাম। সারাদিন হ্যাভেনা চুরুট, কফি ও চা না হলে চলত না। দিনের মধ্যে দশ-বারোটা মুরগির ডিম ভাঙতে হত আমার জন্য, পোস্ত অমলেট হবে। বয়েল বিলেতি মাছও বাদ দেই নি, টোস্টে খুব পুরু মাখনের ওপর জ্যামের পালিশ না থাকলে চলত না; সারা দিন টিনের ও তাজাফল নানা রকম খেতাম। রোজ দুপুরে ঘণ্টা দুই টেনিস খেলতাম বলে হজমের গোলমাল হয় নি কোনোদিন। শরীরটা বেশ। কলকাতায় এসে এ জীবনের কোনো কিনারাই পাওয়া যায় না আর; সঙ্গে আমার নামী-দামি কুমিরের চামড়ার সুটকেশ প্রায় আট-দশটি। হাট-কোট, পাতলুন ও জীবনের শৌখিন আসবাবপত্রে ভরা গোটা দুই চকোলেট রঙের হোন্ড-অল, তিনটে প্লাডস্টোন ব্যাগ, দুটো মস্তবড় ট্যুরিস্ট ট্র্যাঙ্ক, বুড়ি বাস্কেট, ক্যাশবাক্স, লটবহর ইত্যাদি ঢের কিন্তু হাতে যা টাকা আছে তাতে কলকাতার একটা ফাস্টক্লাস হোটেলে উঠলে দিন-ছয়ের বেশি থাকা যায় না। হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাড়িয়ে অবাক হয়ে এক-আধ মিনিট ভাবি; হাতের ছড়িটা এক-আধবার নাচিয়ে নেই; পকেটের থেকে চুরুট বের করে জুলানো যায়, চুরুটে এক টান দিয়ে দেখি অসংখ্য হোটেলের চর আমাকে ছেকে ধরেছে। হাত নেড়ে ভিড়টাকে বিদায় দিয়ে একটা ট্যাক্সি করা যায়; একটা মাঝারি গোছের বোর্ডিঙে গিয়ে উঠি, ম্যানেজার দিনে পাঁচ টাকা হেকে বসেন। আড়াই টাকায় ঠিক হয়। মস্তবড় একটা অন্ধকার ঘর আমাকে দেওয়া হয়। আলো-বাতাস খেলে এ-রকম ছোট একটা কামরা ঘর পছন্দ করে বদলে নেই; নীচের তলায় গোয়ালের মতো একটা স্যাতসেঁতে অন্ধকার ঘরে একটা চৌবাচ্চা, এরই নাম বাথরুম; জলের ভিতর ইদুর মরে আছে না কি আরশোলা পচছে, বোঝা যায় না। কেমন একটা চামসে গন্ধে স্নান করতে হয়। আঁশটে তরকারি, কাচকলা ভাজা, খেশারির ডাল, ট্যাংরা মাছের ঝোল, ভাতের থালা ফেলে চুরুটটা জুলাই আবার। বছর দুই আগে দেশের বাড়িতে একবার গিয়েছিলাম, তখন আমার ব্যবসায়ের ঢের পড়তা। বাড়ি গিয়ে মাস দুই ছিলাম। পরোনো জমির পাশাপাশি নতুন জমি খানিকটা কিনেছিলাম। খড়ের ঘর। আটচালা দুটো ভেঙে ছোটখাটো একটা টালির বাংলো তৈরি করার সঙ্কল্প ঠিক করে এসেছিলাম। কিন্তু হল না কিছু আর। বছর দেড়েক আগেও একবার দেশে গিয়েছিলাম; তখন আমার ব্যবসায়ে ঢের লোকসান চলছে; দিন পনেরো ছিলাম তখন। এবারও দেশেই যেতে হবে; মাঝখানে একবার খবর পেয়েছিলাম বাবার ভয়ঙ্কর হার্টের অসুখ চলছে—মরতে-মরতে বেঁচে রয়েছেন। বড় আশঙ্কার কারণ; এখন খানিকটা ভালো বোধ করি। সঠিক খবর পাওয়া যায় না। নীলিমা ? মা কেমন আছেন? খুবিই বা কত বড় হল? সারা দিন-রাত কী কচ্ছে? বিশেষ কিছু লেখে না বড় একটা কেউ। ব্যবসায়ের প্রথম দুবছর বাবাকে তিনশো টাকা করে মাসে পাঠাতাম। গত বছর এক পয়সাও পাঠাতে পারি নি। অবাক হয়ে ভাবি, দেশেব বাড়ির ব্যাপার কদুর ? শুনেছি, বাবাকে আবার ইস্কুলে যেতে হচ্ছে; অ্যাসিস্টান্ট হেডমাস্টার, যদিও ১৪২