পাতা:জীবনের ঝরাপাতা.pdf/১০১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

মনে আসে বাড়িতে শুয়ে নেই, এক অভিনব পারিপার্শ্বিকে রয়েছি। ভোর হলে কুয়াসায় ছাওয়া গঙ্গার স্বচ্ছতা নিরোধ হয়ে যায়, কুয়াসা সরে সূর্যোদয়ের অনেক পরে সূর্য দৃশ্যমান হলেও সে সূর্যের সঙ্গে বাড়ির চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠতা বৈধ হয়, আর বোটের জানলার ধারে বসে জলের তলায় চলায়মান জলজীবদের গতিবিধি দেখতে মজা লাগে—আমাদের নিত্যপরিচিত নিত্যঅভ্যস্ত স্থলজগৎ নয়, আর এক সম্পূর্ণ বিভিন্ন জগতে যে এসেছি তা হৃদয়ঙ্গম হয়। ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান স্টীম ন্যাভিগেশন কোম্পানির সমুদ্রগামী এক বৃহৎ জাহাজে মাদ্রাজ অভিমুখে যাত্রা করলুম। যেন হঠাৎ বিলেতের একখণ্ডে পদার্পণ করেছি। এখানে একেবারে ইংরেজী জীবনযাত্রা প্রণালী। ভোরের বেলায় ক্যাবিনের ভিতর স্টুয়ার্ডেস চা ও বিস্কুট দিয়ে যায়। তারপর উঠে স্টীমারের সরকারী স্নানাগারে লম্বা টবে স্নান করে সারাদিনের মত বেশভূষা করে নিয়ে ৯টার সময় ভোজনাগারে যাওয়া। সেখানে প্রত্যেকের আলাদা স্থান নির্দিষ্ট আছে। আমাদের তিনজনের একটা টেবিল। ইংরেজী রকম প্রাতরাশের পর ডেকের উপর গিয়ে স্ব স্ব আরামকেদারায় বসে বা অর্ধশয়ান হয়ে বই পড়া, দৃশ্য দেখা, মধ্যে মধ্যে উঠে ডেকে পায়চারি করা, সহযাত্রীদের কারো সঙ্গে আলাপ পরিচয় হলে তাদের সঙ্গে গল্প করা—এই কাজ। কলকাতার জানাশুনা ইংরেজ ও আর্মানী দুই একজন ব্যারিস্টারও এই জাহাজে মাদ্রাজ বেড়াতে যাচ্ছিলেন। এই করতে করতে ১টা হয়ে যায়—তখন মধ্যাহ্নভোজনের জন্যে ভোজনাগারে পুনঃপ্রবেশ। এটা একটা গুরুভোজ, প্রাতভোজনের মত লঘু নয়। এর পর স্ব স্ব ক্যাবিনে গিয়ে বিশ্রাম এবং ঘণ্টা তিনচার পরে কেকাদি-সমন্বিত বৈকালিক চা-পান হয় ক্যাবিনেই বা স্টীমারের ড্রইংরুমে। তারপর ডেকের উপর গিয়ে পাদচারণ বা কোন ব্যায়াম কিংবা ক্রীড়ার দ্বারা সান্ধ্যভোজনের জন্যে ক্ষুধা সঞ্চার। ডিনার খেতে ভোজনাগারে আসার সময় ডিনার সাজ পরে আসা চাই—নয়ত অভদ্র দেখাবে। মেয়েরা সেই সময় নিশ্চয়ই রেশমের পোশাক পরবেন—সূতির নয়। এই হল কায়দা। সেই কায়দা অনুসরণ করে যে যত চলবে, সে তত সভ্য বলে গণ্য হবে—নয়ত অসভ্য আখ্যা পাবে। চতুর্থ দিনে মাদ্রাজ পৌঁছন গেল। এর মধ্যে দেড় দিন মাত্র আমি খাড়া ছিলুম ও স্টীমারের জীবনপদ্ধতি অনুসরণ করেছিলুম। তারপরেই সমুদ্রব্যাধির কবলে পড়লুম। ক্যাবিনেই আমার দিনরাত্রি কাটতে লাগল—কোন কিছু খাওয়ার রুচি আর রইল না—খাদ্যবস্তু দেখলেই গা-বমি

৮৮